নির্বাচন নিয়ে দুই দশক ধরেই দুপক্ষের অবস্থান দুই মেরুতে। আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার কথা বলে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের পথে হেঁটে আসছে। বিএনপি বরাবরই নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অনড়। বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও কেউ ছাড় দেয়নি।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সুন্দর পরিবেশের স্বপ্ন দেখেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। অনেকেই এটিতে আলোচনার পথ প্রশস্ত হওয়ার আলামত পেয়েছেন।
২৩ জুলাই দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত থাকুক- সেটাই আমি চাই। কেউ যদি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে, তাতে যেন বাধা দেওয়া না হয়। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঘেরাও করতে আসলে আসুক। কোনো বাধা দেওয়া হবে না। বাংলামোটরে পুলিশ যে বাধা দিত, সেটাও আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এলে আপ্যায়ন করার পাশাপাশি কথা শুনবেন বলেও আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের চা খাওয়াবো। তাদের কথা শুনব।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর রাজনীতির মাঠে বেশ শীতল বাতাস বইছিল। তবে, শোকাবহ আগস্টের প্রথম দিন (সোমবার) কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য সে পরিবেশ উষ্ণ করেছে। যদিও এটিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আওয়ামী লীগ নেতারা ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছেন।
তারা বলছেন, রাজনীতিতে যুক্তিযুক্ত, শালীন এবং রসবোধক সমালোচনা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অংশ। তবে আলোচনার পথ বা চায়ের আমন্ত্রণ গণতান্ত্রিক পক্রিয়ায় নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করবে।
মাসের প্রথম দিন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দেখেছি বিএনপি নেতারা হারিকেন নিয়ে আন্দোলন করছেন। তো তাদের হাতে হারিকেনই ধরিয়ে দিতে হবে, তাদের সবার হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিন। আর দেশের মানুষকে আমরা নিরাপত্তা দেব এবং দেশের মানুষ যাতে ভালো থাকে সেই ব্যবস্থা নেব।’
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল তাদের বক্তব্য-মন্তব্য দিয়ে যাবেন। এটাই গণতন্ত্রে স্বাভাবিক। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য এবং নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। এটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য- ‘আমার কার্যালয় বা গণভবনে এলেও তাদের চা খাওয়াবো, কথা শুনবো।’ এটাই গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আমার মনে হয়, এই ধারাটাই অব্যাহত থাকুক। পাশাপাশি রাজনৈতিক জবাব-পাল্টা জবাব দেওয়া চলুক, এটা সারা পৃথিবীতেই আছে। একটা বক্তব্য আরেকটা বক্তব্যকে বাধাগ্রস্ত করে না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক জ্বালানি মার্কেটে ডিজেল ও এলএনজির মূল্য এত বেশি পরিমাণ বেড়েছে, যেটা এখন ক্রয়ক্ষমতায় বাইরে। গত ৩০ বছরে তো আন্তর্জাতিক জ্বালানির মার্কেটে এমন অবস্থা হয়নি। এটা বৈশ্বিক সংকট। এটা বাংলাদেশের বা শেখ হাসিনার সরকারের সংকট নয়। সারা দুনিয়া এখন সাশ্রয়ী নীতিতে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। উন্নত সমৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব দেশে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশেও ডিজেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য সাশ্রয়ী নীতি নেওয়া হয়েছে। এটা স্বল্প সময়ের জন্য। পরীক্ষামূলক। উনারা (বিএনপি) এটা নিয়েও রাজনীতি শুরু করলেন। হারিকেন হাতে নিয়ে বলা শুরু করলেন, হারিকেন হারিকেন, হারিকেন ছাড়া উপায় নাই, দেশে বিদ্যুৎ নেই, দেশ ধ্বংস হয়ে গেল। এটা কি রাজনীতি?’
তিনি বলেন, ‘তারা সরকারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চান। অথচ উনারা নিজেরাই খাদের কিনারে। ধাক্কা খেলে খাদের তলদেশে তলিয়ে যাবে। আমরা চাই, তারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও আন্দোলনে আসুক। এজন্য তাদের আলোর পথ খুঁজতে, ভালোর পথ চিনতে প্রধানমন্ত্রী হারিকেন দেওয়ার কথা বলেছেন। যারা সত্যকে অস্বীকার করে, সত্যকে মিথ্যা বলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়, তাদের হারিকেন ধরিয়ে দিতে বলেছেন।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘রাজনীতিতে বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য আসবেই। যুক্তিযুক্ত, শালীন এবং রসবোধক সমালোচনা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এখন সেই সৌন্দর্য চর্চা চলছে। এটি রাজনীতির ইতিবাচক দিক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আলোচনা হবে এবং একটি অর্থবহ নির্বাচনের দিকে জাতি এগিয়ে যাবে। এরই মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।’
তবে বিএনপি বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, প্রধানমন্ত্রী বা সরকার বর্তমান প্রেক্ষাপটকে হালকাভাবে নিচ্ছে। যেটা তাদের ভুল। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, বিএনপি তাদের দাবিতে অনড়।
এ নিয়ে বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার ইতিহাস খুব ভালো নয়। আমরা এক সময়ে দেখেছিলাম, বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ২০০৬-০৭ সালের দিকে আলোচনায় বসেছিলেন। সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। পরে প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন সব দলকে। সেখানে যে প্রতিশ্রুতি এসেছিল সরকারের পক্ষ থেকে, তার একটিও ২০১৮ এর নির্বাচনে বাস্তবায়ন হয়নি। সেই নির্বাচনটি বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে চরম কলঙ্কিত হয়েই থাকবে। সুতরাং এরপর আজ যখন আলোচনার কথা শুনি, তখন আমাদের মনে হয়- বর্তমান রাজনৈতিক সংকট বোধহয় সরকারি দল অনুধাবন করতে পারছে না। দীর্ঘ সময়ে ভোট ছাড়া ক্ষমতায় থাকার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে; তার একটা হচ্ছে, সরকার সবকিছুকে হাল্কাভাবে দেখছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, সরকারি দল যদি বর্তমান সংকট ও বিরোধী দলের আন্দোলনকে হাল্কাভাবে নেয়, তাহলে ভুল করবে।’
‘আমাদের মূল দাবি হচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচন হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচন করবো না। সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ভোট হবে ব্যালটে। এখন প্রধানমন্ত্রী কি এ বিষয়ে আলোচনায় প্রস্তুত? উনি যদি প্রস্তুত থাকেন, পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে, তাহলে আলোচনা হলেও হতে পারে। এর বাইরে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার কিছু নেই’ যোগ করে রুমিন ফারহানা।
হারিকেন হাতে গণসংহতির বিক্ষোভ-ছবি সংগৃহীত
তবে যে যাই বলুক, সবার চাওয়া সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালও বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন, সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন।
ইসির সংলাপে তিনি বলেছেন, ‘ভালো ইলেকশন করাটা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। স্টেকহোল্ডার যারা আছেন, তারাও যদি সমভাবে না আসে, নির্বাচনে রাজনৈতিক আবহ অনুকূল না হয়, দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি সমঝোতা না থাকে; পক্ষগুলো বিবদমান হয়ে যায়, তাহলে আমাদের পক্ষে ভালোভাবে নির্বাচন করাটা দুরূহ।’