২০১৮ সালে তিন মাসের ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাজরাহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা। দেশে না ফিরেই ২০১৯ সালে আরও দুই মাসের জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে ছুটির দরখাস্ত পাঠান। ছুটির ছাড়াই দুই বছর ৯ মাস কাটিয়ে ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ে যোগ দেন। গত ২৮ মার্চ থেকে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন তিনি।
একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক নীনা শাহরিয়ার দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই বছর ছয় মাস কোনও ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত তিনি। তার বোন নিপা শাহরিয়ার শহরের ভিমরুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনিও ছয় মাসের ছুটি নিয়ে ৯ মাস ধরে বিদ্যালয়ে আসেন না।
দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের এমন কর্মকাণ্ডে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে সদর উপজেলা প্রশাসন।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১ জুলাই হাজরাহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নিগার সুলতানা। চার বছর ধরে তিনি নিজের খেয়াল খুশিমতো যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসাসহ বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের চিকিৎসাজনিত ছুটির একটি দরখাস্ত নিজ বিদ্যালয়ে রেখে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যান। অথচ এ ধরনের ছুটির জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মহাপরিচালকের দফতর থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
দেশে না এসেই ২০১৯ সালের ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত আরও দুই মাসের জন্য চিকিৎসাজনিত ছুটির একটি দরখাস্ত উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠান নিগার সুলতানা। দুই বছর ৯ মাস ৮ দিন অননুমোদিত ছুটি কাটিয়ে ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ে যোগ দেন। এরপর তিন মাস সাত দিন বিদ্যালয়ে গেলেও চলতি বছরের ২৮ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুণ্ডু গত ১৫ জুন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানান।
এতে উল্লেখ করা হয়, নিগার সুলতানা এর আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অবহিতকরণ ছাড়াই বিদেশ (যুক্তরাষ্ট্র) যান এবং সেখানে অবস্থান করেন। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বিভাগীয় মামলায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ৪-এর উপবিধি (২) (ঘ) ধারা অনুযায়ী বিভাগীয় উপ-পরিচালক গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর তার বেতন গ্রেড নিম্নতর ধাপে অবনমিত করে প্রারম্ভিক ধাপে নির্ধারণ করে দেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অসুস্থ মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর দরখাস্ত করলে শর্তসাপেক্ষে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের জন্য ছুটি মঞ্জুর করা হয়।
শর্তানুযায়ী, চলতি বছরের ২৭ মে কর্মস্থলে যোগদান করা, ছুটির মেয়াদ কোনোক্রমেই বর্ধিত না করা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগদান করতে ব্যর্থ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু নিগার সুলতানা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সব নির্দেশনা অবজ্ঞা করে এখনও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
একই বিদ্যালয়েরর সহকারী শিক্ষক নীনা শাহরিয়ার ছুটি না নিয়েই আড়াই বছর ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি বিদ্যালয়ে আসেন না। সহকর্মীরা বলছেন, নীনা শাহরিয়ার বর্তমানে ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করছেন।
হাজরাহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ টি এম শামিউল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা দীর্ঘদিন ধরে স্বজনদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। আর সহকারী শিক্ষক নীনা শাহরিয়ার পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তাদের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। আত্মীয়-স্বজনরাও কোনও তথ্য দেন না।’
বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরা জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষক আট জন। তাদের মধ্যে দুই জন অনুপস্থিত, আরও দুই জন মাতৃত্বকালীন ও চিকিৎসাজনিত কারণে ছুটিতে আছেন। আরেকজন আছেন প্রশিক্ষণে। বর্তমানে তিন জন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় চলছে। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী তিন শতাধিক। এত শিক্ষার্থীর বিপরীতে তিন জন শিক্ষক পাঠদান ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
ভিমরুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই অবস্থা। সহকারী শিক্ষক নিপা শাহরিয়ার চিকিৎসাজনিত কারণ দেখিয়ে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে ৯ মাস ধরে বিদ্যালয়ে আসেন না। তিনি কোথায় আছেন সে ব্যাপারে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
ভিমরুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উম্মে ছালমা বলেন, ‘নিপা শাহরিয়ার ২০১২ সালের ২৭ আগস্ট সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাজনিত ছুটি ভোগ করেন। এরপর ১১ নভেম্বর আবারও ছয় মাসের ছুটি নেন। সেই ছুটিও শেষ হয়েছে গত মে মাসে। তারও তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কর্মস্থলে ফেরেননি নিপা।’
এ ব্যাপারে কথা বলতে শিক্ষক নিগার সুলতানা, নীনা শাহরিয়ার ও নিপা শাহরিয়ারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘নীনা শাহরিয়ারের বাসার ঠিকানায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। অননুমোদিত ছুটির বিষয়ে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই কৈফিয়ত তলব করা হলেও আজ পর্যন্ত তার জবাব দেননি। মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। নিগার সুলতানার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নিপা শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম ভূইয়া জানান, শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন কাণ্ড কাম্য নয়। ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। সেই পত্র জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।