স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণে বড় আঘাত আসবে রপ্তানি খাতে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতসহ পাঁচটি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
অন্য দেশগুলো হচ্ছে-চীন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও শ্রীলঙ্কা। পাশাপাশি এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে আরও ৯টি দেশের সঙ্গে। তবে ইন্দোনেশিয়া ও নেপালের সঙ্গে শিগগিরই প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির লক্ষ্যে ২৩টি দেশের সঙ্গে সম্ভাব্য সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে ৮টি নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেগুলো হচ্ছে-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণ, টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানো ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে আরও গতিশীল করা। এছাড়া রপ্তানি বাড়ানো, জেলাভিত্তিক অপ্রচলিত পণ্য নিয়ে গবেষণা এবং চায়ের উৎপাদন বাড়ানো। আরও নির্দেশনা দেওয়া হয় বেসরকারি খাতের সঙ্গে কূটনৈতিক মিশনগুলোর সমন্বয় বৃদ্ধি, বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিটি মিশনে বাণিজ্যিক ইউং স্থাপন।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়-প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশ ছাড়া বাকি সাতটি বাস্তবায়ন হয়েছে। জানা গেছে, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ পরবর্তী বহির্বিশ্বে রপ্তানির ক্ষেত্রে ডিউটি ও কোটা ফ্রি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রপ্তানি খাতে ভর্তুকি তুলে দিতে হবে। এতে রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে অনেক সক্ষমতা হারাবে। সার্বিকভাবে রপ্তানি বাজারে একটি বড় ধরনের ধাক্কা আসবে।
এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) অথবা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সম্পাদন করতে সুপারিশ করেছে এলডিসি উত্তরণ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় গঠিত ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ’ বিষয়ক সাব-কমিটিও। এ কমিটি আরও বলেছে বিকল্প উপায়ে রপ্তানিকে উৎসাহিত করার পন্থা উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএ করার প্রতি জোর দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওই অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, রপ্তানি আয় বাড়াতে প্রাথমিকভাবে ১০টি দেশ ও ৩টি জোটের সঙ্গে এফটিএ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে-ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, মালয়েশিয়। আর জোটের মধ্যে রয়েছে আসিয়ান অর্থনৈতিক জোট, মার্কোসপুর জোট ও ইউরোপিয়ান অর্থনৈতিক জোট।
এছাড়া তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মরক্কো, মরিশাস, সেনেগাল, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, কেনিয়ার সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএ করার ব্যাপারে নেগোসিয়েশন চলছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মতে, উল্লিখিত চুক্তিগুলো সম্পন্ন হলে দেশের রপ্তানি আয় আরও বাড়বে। এতে এলডিসি থেকে উত্তরণে রপ্তানি খাতে যে সংকটের শঙ্কা রয়েছে সেটি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৫০ ভাগই আসে এ অঞ্চলের দেশগুলো হতে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভৌগোলিক দিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাদের মতে, আঞ্চলিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। এজন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক নীতিমালার সংস্কার ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন, পণ্য বহুমুখীকরণ, কর ও শুল্ক কাঠামোর আধুনিকায়ন, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, ক্রস বর্ডার বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে বলা হয় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে গরিব মানুষের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে সাড়ে ৭ লাখ টন খাদ্যপণ্য বিতরণ করবে টিসিবি। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ গুণের বেশি। এরমধ্যে ভোজ্যতেল ২ লাখ ৬১ হাজার ২৬০ টন, মসুর ডাল ২ লাখ ৭৬ হাজার টন, চিনি ১ লাখ ৩৮ হাজার টন, ছোলা ১২ হাজার টন, খেজুর ১৫৬০ টন। এছাড়া পেঁয়াজ ২৪ হাজার টন, আদা ২৪ হাজার টন ও রসুন ১২ হাজার টন। এসব পণ্য এক কোটি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
এর আগের অর্থবছরে ২ লাখ ১১ হাজার টন খাদ্যপণ্য বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, কোনো গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আগাম প্রতিবেদন পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মূল্য নিয়ন্ত্রণে চাল ও গম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উন্মুক্ত করা হয়েছে পেঁয়াজ আমদানি। পাশাপাশি আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে ভ্যাট।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে আরও জোরদার করার বিষয়টি। এ বিষয়ে সেখানে বলা হয়, ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আইন (সংশোধন) পাশ হয়েছে। বর্তমান এ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান অর্গানোগ্রামকে যুগোপযোগীকরণ করে নতুন অর্গানোগ্রাম প্রণয়নের কাজ চলছে।