সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রী ও এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট চাওয়ার সময় কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ক্ষমতায় গেলে মন্ত্রী-এমপিদের আয়ের উৎস ও সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার বিষয়টি ছিল।
ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে দলটি। কিন্তু সরকার এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইশতেহার থেকে প্রসঙ্গটি বাদ দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান শুক্রবার বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হয়। সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশের দিকটি ইতিবাচক হলেও এটি দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানান তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সজুন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শুক্রবার বলেন, দিন বদল করবে-তার অংশ হিসাবে সবাইকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশের অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু একমাত্র তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া কেউ সম্পদের হিসাব প্রকাশ করেননি। বর্তমানে সামগ্রিক গুণগত মানের অবনতি তারই প্রতিফলন। মন্ত্রী-এমপিদের লুটপাটের মাধ্যমে রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, স্বার্থপরতার রাজনীতির অবসান করতে সংসদ-সদস্যদের সদাচরণের কোনো বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা অনুচ্ছেদে (৫.৩) বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ-সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ ওই নির্বাচনি ইশতেহারে বিএনপির শাসনামলের কঠোর সমালোচনা করা হয়। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ বলে দাবি করে দলটি। ইশতেহারের এক অংশে ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসন; সংকটাপন্ন বাংলাদেশ’ শিরোনাম দিয়ে আওয়ামী লীগ উল্লেখ করে ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরে দুঃশাসনের ফলে এই সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে।’
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে ‘সুশাসন’ অনুচ্ছেদটি বাদ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ-সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশের অঙ্গীকার থেকে সরে আসে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনি ইশতেহার থেকে লাইনটি পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা হয়। এর পরিবর্তে ‘সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন’ অনুচ্ছেদে (১.২ সংবিধান ও সংসদ) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নতুন অঙ্গীকার করে বলে ‘সংসদের ভেতরে ও বাইরে সংসদ-সদস্যদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনানুগ বিধিবিধান করা হবে।’
সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে ঘোষিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকেও মন্ত্রী-এমপিদের আয়ের উৎস ও সম্পদের হিসাব প্রকাশের অংশটি বাদ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনি ইশতেহারে সরকার পরিচালনায় দুই মেয়াদে (২০০৯-২০১৮) সাফল্য ও অর্জন এবং আগামী পাঁচ বছরের (২০১৯-২৩) লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অনুচ্ছেদে (৩.৩ দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন) ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং আধুনিক প্রশিক্ষণের ফলে সরকারি দপ্তরে কাজের যে দক্ষতা ও পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত ঘোষণা দিয়েছিলেন, শুধু মন্ত্রী-এমপি নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাবও প্রতিবছর জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ কাজে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বলেন, আগামী জুনের (২০১০ সাল) আগেই মন্ত্রী-এমপি, বিচারপতি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশ করা হবে।
কিন্তু ওই বছরই (২০১০) মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আয়কর বিবরণীতে দেওয়া হিসাবই যথেষ্ট। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নতুন করে আর সম্পদের হিসাব দিতে এবং জনসমক্ষে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে না। নির্বাচনের আগে দাখিল করা তথ্যই এজন্য যথেষ্ট। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত তখন বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, সংসদ-সদস্য ও বিচারপতিদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে। কিন্তু এরপরও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। ওই বছরের ৪ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী-উপদেষ্টারা তাদের সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সংসদ-সদস্য এবং বিচারপতিদের বিষয়ে স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রাষ্ট্রপতির কাছে তার সম্পদের হিসাব দেন। অনেক বিচারপতিও তাদের সম্পদের হিসাব প্রধান বিচারপতিকে দিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ থাকলেও তা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ হয়নি। ২০১৪ সালে এসে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহার থেকে প্রসঙ্গটি পুরোপুরি বাদ দেয়।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের এক অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপিরাও সম্পদের হিসাব দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।