দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গ্রহণযোগ্য হিসাব পদ্ধতি প্রণয়নের ব্যাপারে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, সুদের হারে আরোপিত সীমা প্রত্যাহার, মন্দ ঋণ কমানো এবং সম্ভাব্য খেলাপি ঋণ ঠেকাতে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তাও তারা জানতে চেয়েছে। এছাড়া রাজস্ব খাতে সংস্কার, কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার বিভিন্ন সূচকের হালনাগাদ চিত্র সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে।
আইএমএফ-এর প্রশ্নগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের পর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করছে। প্রতিবেদনটি তারা আইএমএফ-এর মিশনকে দেবে। একই সঙ্গে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হবে। আইএমএফ-এর সঙ্গে বৈঠকের সময় এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা হবে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ঋণ সুবিধা দিতে আইএমএফ-এর একটি মিশন বুধবার রাতে ঢাকায় আসবে। তারা ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-সহ বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। এসব বৈঠকে ঋণ পাওয়ার জন্য আইএমএফ-এর শর্তের বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা হবে। এবারের মিশনেও নেতৃত্ব দেবেন এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ। মিশনটি গত জুলাইয়ে ঢাকায় এসেছিল। ২২ জুলাই তারা বাংলাদেশ মিশন সম্পন্ন করে ঢাকা ত্যাগ করে। এবারের মিশনের বৈঠক শুরু হবে বৃহস্পতিবার থেকে। ওইদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হবে। প্রতিদিন তারা একাধিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রায় দিন বিকালেই বৈঠকে বসবে। মন্দা মোকাবিলায় আইএমএফ-এর কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে সরকার আইএমএফ-এর ঋণ পেতে বড় একটি শর্ত বাস্তবায়ন করেছে। সেটি হচ্ছে-জ্বালানি তেল ও সারের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কিছুটা কমিয়েছে। এর বাইরে অন্য যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলোর একটি অংশও বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আংশিকভাবে হলেও বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আইএমএফ চাচ্ছে এটি পুরোপুরিভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভিন্নমত রয়েছে। তারা বলেছে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশও তাই করছে। একেবারে বাজারের হাতে তা ছেড়ে দিলে বাজার অস্থির হয়ে যাবে। ডলারের সরবরাহ বাড়লে দাম বেশি কমে যাবে। আবার ডলারের সরবরাহ কমে গেলে দাম বেশি বেড়ে যাবে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে বাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখছে। বিনিময় হারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুই ধরনের দর নির্ধারণ করে। একটি সাধারণ বা নমিনাল বিনিময় হার। এটি হচ্ছে বর্তমান বাজার দর। অন্যটি হচ্ছে রিয়েল বা প্রকৃত বিনিময় হার। এটি মুদ্রার মান সম্পর্কে ধারণা পেতে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য আছে-এমন সব দেশের মুদ্রার মান, মূল্যস্ফীতি, জিডিপির প্রবৃদ্ধি এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়। নমিনাল বিনিময় হারে বর্তমানে ডলারের দরও বিভিন্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করছে ৯৭ টাকা দরে। রপ্তানি বিল কেনা হচ্ছে ৯৯ টাকা দরে। রেমিট্যান্স কেনা হচ্ছে ১০৭ টাকা দরে। ফলে ডলারের কোনো একক দর নেই। আইএমএফ এ খাতে সমন্বয় আনার কথা বলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, নিয়ন্ত্রিত বাজার থেকে ক্রমেই বাজারভিত্তিক দরের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে কারণে এখন বিনিময় হারে কিছুটা হেরফের হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তা ঠিক হয়ে যাবে। প্রকৃত বিনিময় হার এখন ১১৫ টাকার বেশি। আইএমএফ বাজার ও প্রকৃত বিনিময় হারের মধ্যে সমন্বয় করার কথা বলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এ বিষয়ে ব্যবধান অনেক কমে এসেছে। আগামী দিনে আরও কমে যাবে।
আইএমএফ বলেছে, রিজার্ভের যেসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। এ খাতে গ্রহণযোগ্য হিসাব পদ্ধতি প্রণয়নের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলছে। কিন্তু এটি করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে দুই ধরনের হিসাব তৈরি করা হয়। একটি সাধারণ বা গ্রস এবং অপরটি প্রকৃত বা নিট হিসাব।
আইএমএফ বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রস হিসাবটি প্রকাশ করছে; কিন্তু নিট হিসাবটি প্রকাশ করছে না। গ্রস হিসাবে রিজার্ভ বেশি দেখাচ্ছে। এতে বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে। এ কারণে নিট হিসাবটিই প্রকাশ করার শর্ত দিচ্ছে আইএমএফ। কিন্তু নিট হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে ৭০০ কোটি ডলার, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে ২০ কোটি ইউরো ও ২০ কোটি ডলার এবং শিল্প স্থাপনের উদ্যোক্তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিতে আরও একটি তহবিল রয়েছে। এসব তহবিলের অর্থও রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। আইএমএফ এসব তহবিলে বরাদ্দ অর্থ রিজার্ভ থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে (বিদেশে বাংলাদেশি ব্যাংকের হিসাব) জমা বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতিও আলাদা ও গ্রহণযোগ্য করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বর্তমানে গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ৩ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার। তহবিলগুলোয় বরাদ্দ অর্থ বাদ দিলে তা ৩ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে আসে।
আইএমএফ ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে দিতে বলেছে। বর্তমানে সুদের হারে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ও আমানতে ৬ শতাংশ সুদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এ সীমা তুলে দিলে সুদের হার বেড়ে যাবে। তখন খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। মন্দা কেটে গেলে পর্যায়ক্রমে সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়া হবে।
খেলাপি ঋণ নীতিতে পরিবর্তন ও ঋণ পরিশোধে ছাড়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দায় এ খাতে প্রণোদনার অংশ হিসাবে কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটি আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। পর্যায়ক্রমে তা উঠে যাবে।
রাজস্ব খাত সংস্কারে আইএমএফ দীর্ঘ সময় ধরেই চাপ দিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এ খাতে সংস্কার হয়নি। বর্তমানে কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। এ হার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যেতে বলেছে আইএমএফ।