দ্রব্যমূল্য ও তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে বড় ধরনের বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সর্বশেষ আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে সবচেয়ে বড় সমাবেশটি করবে বলে পূর্বেই ঘোষণা দেয় দলটি। বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ শুরুর পর থেকেই সারাদেশে বেড়েছে দলটির নেতাকর্মীদের নামে মামলা দায়েরের প্রবণতা। একই সঙ্গে নতুন ও পুরোনো মামলায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তারে তৎপর হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে এখন কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাসহ দলের মধ্যম সারির বেশির নেতাই রয়েছেন আত্মগোপনে। গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলে চলাফেরা করছেন বেশিরভাগ নেতারা। একই সঙ্গে গণসমাবেশের স্থান ইস্যুতেও কিছুটা নমনীয়ভাব দেখা গেছে দলটির শীর্ষ নেতাদের মাঝে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় মধ্যম সারির নেতা ও কর্মীদের সংগঠিত করতে পারে এমন নেতাদের বেছে বেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের টার্গেট করা হচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, বিএনপি নেতাদের টার্গেট করে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সঠিক নয়। আইনের মধ্যে থেকেই অভিযান পরিচালনা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতাদের মতে, ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে বেড়েছে বিরোধীমতের ওপর হামলা-মামলা করেই সরকার এখনও ক্ষমতায় টিকে আছে। সাজানো নাশকতার ঘটনায় গায়েবি মামলা দিয়ে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বেছে বেছে এমন সব নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে যারা দল ও কর্মীদেরকে সংগঠিত করতে পারে।
রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ১ নম্বর সদস্য ইশরাক হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে সোমবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকেই ইশরাক হোসেন তার ব্যক্তিগত সহকারীসহ নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেছে বিএনপি।
সোমবার সকাল থেকে দুপুরের পর পর্যন্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাসা ঘেরাও করে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করার কথা রয়েছে মির্জা আব্বাসের।
গত সোমবার গভীর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের রায়েরবাজারের বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে পরিবারের সদস্যরা। ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীসহ পরিবারের সদস্যরা এই বাড়িতে থাকেন। তবে অভিযানকালে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নিপুণ রায়কে বাসায় না পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ফিরে যান।
চলতি মাসের ১ তারিখে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) চিঠি দিয়ে রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক বেআইনি, মিথ্যা ও গায়েবি মামলা বন্ধের আহ্বান জানায় বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল সেদিন আইজিপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চিঠি এবং জেলাভিত্তিক নেতাকর্মীদের মামলা ও গ্রেপ্তারের একটি তালিকা দেয়। বিএনপির দেয়া চিঠিতে বলা হয়, গত ২২ আগস্ট থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৯টি গায়েবি ও মিথ্যা মামলায় নাম ধরে আসামি করা হয়েছে ছয় হাজার ৭২৩ জনকে। এছাড়াও বেনামে আসামি করা হয়েছে ১৫ হাজার ৫০ জনকে। ইতোমধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১৫০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি বিএনপির। একই সঙ্গে প্রতি রাতে নেতাকর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি ও নির্যাতনে দেশে ভয়াবহ ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ দলটির।
এদিকে, গত ২২ আগস্ট থেকে গতকাল ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩২৮টি গায়েবি মামলা করা হয়েছে বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ১০ হাজার ৩৮০ জন এবং অজ্ঞাত পরিচয় আসামি ২৪ হাজার ১৭৩ জন। আর ৯৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ৩০ নভেম্বর রাত থেকে ৬ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত ছয় দিনে কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোশারফ হোসেন খোকনও রয়েছেন।
গণমাধ্যমকে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সারাদেশে বর্তমানে গায়েবি ও মিথ্যা মামলা এবং গ্রেপ্তারের হিড়িক চলছে। হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার করে জনগণের আন্দোলনকে দমানো যাবে না। দেশের মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র ফেরাতে বিএনপিসহ গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার শপথ নিয়েছে তৃণমূল। কোনো বাধাই বিএনপির কর্মসূচি ঠেকাতে পারবে না।’
অন্যদিকে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ‘বিএনপি নেতাদের টার্গেট করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, আইনের মধ্যে থেকে কাজ করছে পুলিশ। নিয়মের বাইরে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে সুনির্দিষ্টভাবে বিশেষ অভিযান চলছে। জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী ও কারবারি, অবৈধ অস্ত্রধারী ও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে এই অভিযান। অভিযানে রাজনৈতিক কারণে তো কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, সে সুযোগও নেই। এখন কারও বিরুদ্ধে যদি মামলা-ওয়ারেন্ট থাকে, তাহলে পুলিশ তো গ্রেপ্তার করবেই।’
এদিকে, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীদের এভাবে গ্রেপ্তার ও ব্যাপক ধরপাকড়ের পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলের অংশ হিসেবে কিছুটা নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি। দলটি গ্রেপ্তার ও সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকায় সমাবেশ করতে চায়, যাতে কর্মসূচি ঘিরে সরকার কোনো ফায়দা নিতে না পারে। সে কারণে দলটি বলেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তুরাগ নদের তীর ছাড়া ঢাকার ভেতরে অন্য জায়গায় সমাবেশের প্রস্তাব দিলে সেটা বিবেচনা করা হবে।