সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি সাধারণ বিমা কোম্পানি মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। আইন লঙ্ঘন করে বাকিতে বিমা ব্যবসা, অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া, প্রিমিয়াম আয়ের মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনসহ রয়েছে বেশি কিছু অভিযোগ। তবে এসব অনিয়ম ২০২০ সালের আগের দাবি করে এখন সবকিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও।
কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়সহ একাধিক শাখা পরিদর্শন ও বিশেষ নিরীক্ষায় এসব অনিয়মের তথ্য পেয়েছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের তথ্য যাচাই করে এসব অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস দিয়ে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সে বিশেষ নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বিমা কোম্পানিটির ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের প্রিমিয়ামের তথ্য পর্যালোচনা করে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পায়।
প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসে, ২০১৩ সালে কোম্পানিটি ৪৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭৯ টাকা প্রিমিয়াম আয় করে। কিন্তু আর্থিক বিবরণীতে দেখানো হয় ৩৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮ টাকা। অর্থাৎ প্রিমিয়াম ৯ কোটি ৯৪ লাখ ১১ হাজার ৭৮১ টাকা কম দেখানো হয়।
একইভাবে ২০১৪ সালে ৪৭ কোটি ২৭ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫৯ টাকা প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয় ৩৯ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৬২৫ টাকা। ২০১৫ সালে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার ৮৮০ টাকা প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয় ৪১ কোটি ৯৮ লাখ ৪১ হাজার ১২২ টাকা।
এই তিন বছরে (২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল) কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়াম আয় কম দেখিয়েছে ২৬ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭৩ টাকা। এভাবে প্রিমিয়াম আয় কম দেখানোর মাধ্যমে কোম্পানিটি ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক সরকারি কোষাগারে কম পরিশোধ করেছে।
আইডিআরএ সূত্র জানিয়েছে, এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩ কোটি ৭১ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩২ টাকা, ২০১৭ সালে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪৫০, ২০১৬ সালে ১ কোটি ৭০ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৬, ২০১৫ সালে ২ কোটি ৬১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৪, ২০১৪ সালে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮০, ২০১৩ সালে ১ কোটি ৮০ লাখ ১ হাজার ৩১১ এবং ২০১২ সালে ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৪১৬ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে কোম্পানিটি।
এদিকে প্রকৃত প্রিমিয়াম পরিবর্তন করে কৃত্রিম প্রিমিয়াম দেখিয়ে ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকি এবং তহবিল তছরুপ করা হয়েছে বলে আইডিআরএ’র একটি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকিসহ আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে নবাবপুর শাখায় ৯৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, বংশাল শাখায় ৯৭ দশমিক ১১ শতাংশ, মতিঝিল শাখায় ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, মহাখালী শাখায় ৯৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং প্রিন্সিপাল শাখায় ৯৯ দশমিক ৩২ শতাংশ হ্রাস করে কোম্পানির কম্পিউটারে ডেটাবেজে রেকর্ড করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এর ভিত্তিতে আইডিআরএ বলছে, কোম্পানির ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের ব্যবসার তথ্য প্রকৃত নয়, ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকিসহ তহবিল তছরুপ করার উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে তৈরি হিসাব। কোম্পানির কৃত্রিমভাবে প্রিমিয়াম হ্রাস করার গড় হার ৯৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এটা বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানির প্রদর্শিত প্রিমিয়ামের সঙ্গে যোগ করা হলে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রকৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি হবে এবং ১৫ শতংশ হারে ভ্যাট প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
আইডিআরএ আরও বলছে, প্রতি বছর কোম্পানিটিতে প্রকৃত প্রিমিয়ামের চেয়ে কম প্রিমিয়াম দেখিয়ে ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকি এবং তহবিল তছরুপ হয়েছে, যা বিমা পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থে বা ব্যবসা উন্নয়নের পরিপন্থি বা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি।
এদিকে প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে কমিশনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম করেছে এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি। আইডিআরএ’র পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দিলকুশা শাখা মোট ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৭২৩ টাকা প্রিমিয়াম আয় করে। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে কমিশন হয় ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯০৮ টাকা। কিন্তু ২০১৮ সালে কোম্পানিটি সৈয়দ মমতাজুল নাসের নামের একজনকে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৯৪ টাকা কমিশন দিয়েছে, যা মোট প্রিমিয়াম আয়ের ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
আইন লঙ্ঘন করে সৈয়দ মমতাজুল নাসেরকে অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া হলেও এই শাখা তার নামে এজেন্ট লাইসেন্স দেখাতে পারেনি। যেহেতু প্রত্যেক বৈধ এজেন্টের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক, তাই লাইসেন্স না থাকায় এজেন্ট হিসেবে সৈয়দ মমতাজুল নাসের বৈধতা নেই বলে অভিমত দিয়েছে আইডিআরএ। এক্ষেত্রে একজন লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তিকে কমিশন দিয়ে কোম্পানিটি বিমা আইন ২০১০ এর ৫৮ ধারা লঙ্ঘন করেছে। তাছাড়া এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করছে আইডিআরএ।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, যেসব অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে তা ২০২০ সালের আগে। ওই সময় আমি মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের সিইও ছিলাম না। এখন আমরা সব নিয়ম-কানুন মেনে চলছি।
সরকারের ফাঁকি দেওয়া রাজস্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ভ্যাটের বিষয়টি আমরা দেখেছি। ভ্যাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা কথা বলছি। ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার যে তথ্য এসেছে আমরা তা পরিশোধ করে দেবো। কাগজ-কলমের হিসাবে যা আসে, সেটা নিয়ে আমরা বসছি।