একজন নাগরিক কীভাবে সেই বিচারিক সুরক্ষা পেতে পারে, তা না জানার কারণে অনেক সময় প্রতিকার পান না বা হয়রানির শিকার হন। মামলা দায়েরের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকলে হয়রানি থেকে রক্ষা পাওয়া অনেকাংশে সম্ভব।
বৈশিষ্ট ভেদে ফৌজদারি ও দেওয়ানী দুই ধরনের মামলা হয়ে থাকে। ফৌজদারি মামলা হয় এমন কোনো অপরাধ সংঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে যা দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেমন- খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হলে। অপরদিকে দেওয়ানী মোকদ্দমা সাধারণত, সম্পত্তির মালিকানা ও দখল ইত্যাদি সংক্রান্ত বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ, অর্থ সংক্রান্ত বিরোধ বা মানহানির ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি কারণে হতে পারে।
আর ফৌজদারি মামলা থানা অথবা আদালত দুই জায়গায়ই করা যায়। যখন একটি মামলা থানায় দায়ের করা হয়, তখন তাকে বলা হয় জেনারেল রেজিস্ট্রার (জিআর) মামলা, আর যখন আদালতে দায়ের করা হয় তখন তাকে বলা হয় কমপ্লেইন্ট রেজিস্ট্রার (সিআর) কেস বা নালিশী মামলা। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর বিধান অনুযায়ী এসব মামলা দায়ের করতে হয়।
জিআর মামলা: থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর লিখিত এজাহার দায়েরের মাধ্যমে জিআর মামলার সূচনা হয়। কোনো ধরনের বিলম্ব না করে অপরাধের শিকার ভুক্তভোগী নিজে বা অন্য কেউ এই এজাহার দায়ের করতে পারেন। যিনি এজাহার দায়ের করবেন তাকে এজাহারকারী বা সংবাদদাতা বলা হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারার বিধান মোতাবেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমলযোগ্য অপরাধের মামলা গ্রহণ করে থাকেন। সংবাদদাতা (এজাহারকারী/বাদী) স্বাক্ষরিত এজাহার পেয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উহার সারমর্ম নির্ধারিত ফর্মে লিপিবদ্ধ করবেন, যাকে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআর বলা হয়। প্রত্যেকটি মামলা রেকর্ডের সময় সরকারের নির্ধারিত আকারে রক্ষিত একটি বহিতে লিপিবদ্ধ করতে হয় এবং একটি নম্বর দেওয়া হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৬ ধারা মোতাবেক এ ধরনের মামলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই পুলিশ তদন্ত করতে পারবে।
যখন আমল অযোগ্য অপরাধে থানায় মামলা হয় বা সাধারণ ডায়েরি হয়, তখন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৫ ধারা মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতীত পুলিশ অভিযোগের তদন্ত শুরু করতে পারবে না। এই ধরনের মামলাকে নন-জিআর বা নন-এফআইআর মামলা বলা হয়।
সিআর মামলা বা নালিশী মামলা: ফৌজদারি মামলা যদি পুলিশ গ্রহণ না করে বা গ্রহণ করতে গড়িমসি করে, তখন আদালতেও মামলা দায়ের করা যায়। আদালতে দায়ের করা এই মামলাকেই সিআর বা নালিশী মামলা বলে। এরূপ ক্ষেত্রে সাধারণত একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা দায়ের করতে হয়। তবে, বাদী নিজেও মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এ ধরনের মামলা সাধারণত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা তার অধীনস্থ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষমতা সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দায়ের করতে হয়। বিশেষ আইনের ক্ষেত্রে যদি বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল থাকে সেই আদালতে দায়ের করতে হয়। যেমন-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে দায়ের করতে হয়।
আদালতে দায়ের করা মামলার অভিযোগকে আরজি বলা হয়। যিনি আরজি দায়ের করেন তাকে ফরিয়াদী/বাদী এবং যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় তাকে আসামি বলা হয়। আরজিতে আদালতের নাম, যে আইনে মামলা দায়ের হবে সেই আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা, বাদী ও আসামির নাম-ঠিকানা, সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা এবং ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করতে হয়। নালিশের ভিত্তিতে অপরাধ আমলে নেওয়া হলে ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় বাদী ও উপস্থিত সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ করবেন। জবানবন্দির সারাংশ ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করবেন এবং উহাতে বাদী বা সাক্ষীর সই নেবেন।
এরূপ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট আরজিকে এফআইআর গণ্য করে সংশ্লিষ্ট থানা কর্তৃপক্ষকে মামলা হিসেবে রেকর্ডের আদেশ দিতে পারেন। সেরূপ আদেশ দিলে এফআইআর গ্রহণের পর থেকে মামলাটি জিআর মামলা হিসেবে গণ্য হবে। ম্যাজিস্ট্রেট আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বা সমন ইস্যু করতে পারেন। অথবা ২০২ ধারার বিধান মোতাবেক পরোয়ানা স্থগিত রেখে ম্যাজিস্ট্রেট নিজে বা তার অধীনস্থ কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বা কোন পুলিশ অফিসারকে অনুসন্ধান বা তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।
নালিশ খারিজ: ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৩ ধারা মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেট অনুসন্ধান বা তদন্তের ফলাফল (যদি থাকে) বিবেচনা করে অগ্রসর হওয়ার মতো কোনো কারণ না পাইলে নালিশটি খারিজ করতে পারবেন। তবে, খারিজ করার কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে।