সবেমাত্র রোজার শুরু। ঈদের আমেজ শুরু হয়নি এখনো। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে গেছে চাঁদার ফরমান। ঈদের আগেই কোটি টাকা চাঁদা তোলার টার্গেটে মাঠে নেমেছে দেলোয়ার হোসেন দেলুর ‘তিন টেক্কা বাহিনী’।
এই বাহিনীর দাপটে অতিষ্ঠ রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তানে অবস্থিত সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন তিনটি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। তারা ভীতসন্ত্রস্ত। আতঙ্কে মার্কেট ছাড়ছেন কেউ কেউ।
বাহিনী সদস্যরা নিজেদের গোপালগঞ্জের বাসিন্দা ও বাগেরহাটের একজন সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে প্রভাব বিস্তার করছে।
আতঙ্কিত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শুধু চাঁদাবাজি নয়, তারা জাকির সুপার মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট ও নগর প্লাজার উচ্ছেদ করা দোকানের খালি জায়গা ফের অবৈধ দখলে নিয়ে অস্থায়ী দোকান তৈরি করছে।
বর্তমান মেয়র ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কেট তিনটি থেকে বিপুলসংখ্যক অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেন। কিন্তু এক বছর পার হতেই দেলু চক্রের সদস্যরা ফের মার্কেটের খালি জায়গাগুলো দখল করতে শুরু করেছে।
অবৈধ এই কাজ নির্বিঘ্ন করতে চক্রের সদস্যরা দোকান মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এখন মরিয়া। যেসব ব্যবসায়ী তাদের অন্যায়, অপকর্মের প্রতিবাদ করছে তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে শায়েস্তা করা হচ্ছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে উল্লিখিত সব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, এক সময়ের বিএনপি কর্মী হিসাবে পরিচিত জামাল হোসেন তিন টেক্কা বাহিনীর হয়ে জাকির সুপার মার্কেটে চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চক্রের অন্য দুই সদস্যের মধ্যে আবুল হোসেন বাবু ওরফে ইতালিয়ান বাবু নগর প্লাজায় ও ফকরুল ইসলাম সিটি প্লাজায় তৎপর।
ফকরুল মেরুল মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ী। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। আবুল হোসেন বাবু ওরফে ইতালিয়ান বাবুর বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীতে, জামাল হোসেনের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লার হাট।
এরা তিনজনই গোপালগঞ্জের বাসিন্দা ও বাগেরহাটের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নেপথ্যে আছেন দেলোয়ার হোসেন দেলু।
মার্কেটের ছোট টং দোকান, পান দোকান, ভাতের দোকানসহ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও তাদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। অভিযোগ আছে, প্রতারণাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে দেলু এখন মার্কেট ছাড়া।
এ কারণে জামাল, বাবু ও ফকরুলকে অবৈধভাবে মার্কেটে ঢুকিয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন। ফের বিভিন্ন খাত থেকে শুরু করেছেন চাঁদাবাজি। ব্যবসায়ীদের কাছে এরাই দেলুর ‘তিন টেক্কা বাহিনী’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।
জানতে চাইলে, দেলোয়ার হোসেন দেলু বলেন, ‘জামাল, বাবু ও ফকরুল আমার লোক। কিন্তু ওরা চাঁদাবাজি করে না। আমার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবসায়ী সামনাসামনি চাঁদাবাজি দূরের কথা কোনো ধরনের অভিযোগ করতে পারবে না।
আমার হাতে গড়া মার্কেটে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা তো হতে পারে না। মূলত যারা চাঁদাবাজি করছে কেউ তাদের নাম বলছে না। আমি মার্কেটে যাই না। যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে এগুলো মিথ্যা। ফিরোজ নামের একজন জেল থেকে বেরিয়ে এসব অভিযোগ করছে। তাকে র্যাব ধরেছিল।’
ব্যবসায়ীরা জানান, দেলোয়ার হোসেনের নতুন গড়া ‘তিন টেক্কা বাহিনী’র চাঁদাবাজির স্টাইল বা কৌশল ভিন্ন। তিন মার্কেটের সামনের খালি জায়গায় বসে ব্যবসা করছেন অন্তত ৩০০ ব্যবসায়ী। তাদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা ধরা হয়েছে। ঈদের আগে এ খাত থেকে অন্তত ১৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন তাদের দোকান তুলে দেওয়া হবে বলে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। তিন মার্কেটে স্থায়ী দোকান আছে প্রায় ২ হাজার ৫০০। প্রতি দোকান থেকে ইফতার বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা করে চাঁদা ধরা হয়েছে। এ খাত থেকে চাঁদা তোলার টার্গেট নেওয়া হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিন মার্কেটে আলোক সজ্জা বাবদ প্রতি দোকান মালিকের কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে মোট ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা চাঁদার টার্গেট করা হয়েছে। এছাড়া পানির বিল বাবদ দোকানপ্রতি ৫০০ টাকা হারে মোট ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা চাঁদা ধরা হয়েছে। মোট কোটি টাকার বেশি চাঁদা তুলতে মরিয়া তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। নগর প্লাজা দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান জানান, মার্কেট পরিচালনার নামে বিভিন্ন খাত থেকে ঈদের আগে কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে ‘তিন টেক্কা বাহিনী’।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা তাদের এই ফরমান মানতে রাজি নয়। এরই মধ্যে তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা নিজেদের উদ্যোগে মার্কেট আলোকসজ্জা করবে বলে সাফ জানিয়েছে।
হয়েছে। তারা নিজেদের উদ্যোগে মার্কেট আলোকসজ্জা করবে বলে সাফ জানিয়েছে।
একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এর আগে মার্কেট সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু বিদ্যুৎ বিল, পানি বিলসহ বিভিন্ন খাতের নাম করে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলে আত্মসাৎ করেছেন।
এক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা চাঁদা তুলে প্রতি মাসে চার লাখ টাকা করে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছেন। দেলোয়ার হোসেনের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, জাকির সুপার মার্কেটের সিদ্দিক বাজার পানির ট্যাংকির গেট (পূর্ব-দক্ষিণ কর্নার) সংলগ্ন খালি জায়গায় অস্থায়ীভাবে অবৈধ ৮টি দোকান বসানো হয়েছে। অস্থায়ী এ দোকান বাবদ মাসিক ৫ হাজার টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে চক্রটি।
ওয়ালিউল্লাহ ওরফে লাদেন, আলমগীর হোসেন, আবু জাফর, আব্দুল্লাহ জুবায়ের, হাসানসহ মোট ৮ জন ব্যবসায়ী অবৈধভাবে জুতার দোকান বসিয়েছে।
অবৈধভাবে দোকান করার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ জুবায়ের বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে একটি চক্র আমাদের দোকান বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেই দোকান উচ্ছেদ করেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্তদের কয়েকজন এখানে দোকান করে খাচ্ছি। আমরা তো পাকাঘর নির্মাণ করিনি। সুন্দরবন মার্কেটে উচ্ছেদ করা দোকান ফের সাটার লাগিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ওগুলো কেউ দেখে না।’ জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন জাকির সুপার মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট ও নগর প্লাজা ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বাণিজ্য ফেঁদে বসেছিলেন মার্কেটের মালিক সমিতির ‘বিতর্কিত’ সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু।
কিন্তু বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর দেলু বাহিনীর চাঁদাবাজি ও অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। মার্কেটের অবৈধ সব দোকান উচ্ছেদ করলে ব্যবসায়ীদের আন্দোলন ও তোপের মুখে পড়ে মার্কেটছাড়া হন দেলু।
তখন মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এক সময় দেলুর ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত জাকির সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ। তিনি ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তাদের নিয়ে দেলুর দোকান বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন।
এতে দেলু বাহিনীর সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে ফিরোজসহ প্রতিবাদী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিতে থাকেন। এরই জের ধরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ফিরোজসহ ছয় ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
র্যাবের অসৎ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফিরোজসহ প্রতিষ্ঠিত ছয় ব্যবসায়ীর গায়ে লাগানো হয় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ তকমা। এরা কারাগারে থাকা অবস্থায় দেলু ফের চাঁদাবাজি ও দোকান বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে জামাল হোসেন, আবুল হোসেন বাবু ও ফকরুল ইসলামকে কৌশলে মার্কেটে ঢুকিয়ে দেন।
এরাই নতুন করে ঈদ সামনে রেখে কোটি টাকা চাঁদা তোলার টার্গেটে তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন দেলু।
ব্যবসায়ী নেতা ফিরোজ আহমেদ বলেন, এই চক্রের চাঁদাবাজি ও দোকান বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে আমাকে চরম খেসারত দিতে হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজন মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আরও অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
এই চক্রের প্রধান দেলোয়ার হোসেন মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির পদ দখলে রেখেছেন ২৬ বছর ধরে। এক্ষেত্রে শ্রম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে সমিতির নির্বাচন আটকেও রেখেছেন।
জানতে চাইলে জামাল হোসেন বলেন, ‘দেলোয়ার হোসেন এখন মার্কেটে আসেন না। তাই তার প্রতিনিধি হিসাবে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ওনার কথামতোই আমি কিছু কিছু বিষয় দেখছি। তবে আমি মালিক সমিতির কোনো পদে নেই। আমি এত কাঁচা না যে নির্বাচন ছাড়া সমিতির পদে বসব। আমার বিরুদ্ধে কেউ চাঁদাবাজি ও দোকান বাণিজ্যের অভিযোগ করে থাকলে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ এটা করছে কিনা-তা খতিয়ে দেখব।’
আপনি কি ইফতার ও আলোকসজ্জা বাবদ ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা নির্ধারণ করে দিয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ ঠিক নয়। কয়েকজন ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের কাছে গিয়েছিলেন। এরপর তার ভাগ্নে রবিন আমাকে এ নিয়ে আলোচনা করতে বলেন। পরে ব্যবসায়ীরাই আলাপ-আলোচনা করে চাঁদার হার ঠিক করেছেন। এ বিষয়ে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মার্কেটের ১৬ নম্বর দোকানটি আমার। আমি ব্যবসা করি।’
আবুল হোসেন বাবুর দুটি মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। প্রতিবারই নম্বর দুটি বন্ধ পাওয়া গেছে। আর ফকরুল ইসলাম বলেন, ‘মার্কেট তিনটির অল ইন অল দেলোয়ার হোসেন। দেলোয়ার ভাই আমার কাছের লোক। তার কথামতোই আমি কাজ করছি। আমি চাঁদাবাজি করতে যাব কেন? যদি কেউ আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারে তাহলে আর কোনোদিন মার্কেটে যাব না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। আমি গোপালগঞ্জ জেলা যুবলীগের সহসভাপতি।’