স্বামী ইলিয়াস আলী নিখোঁজের এক দশক পর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরাই যে ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে গেছেন, এটা নিশ্চিত। আর ঘটনার পর তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাক্ষাতের আয়োজন এবং ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার আশ্বাস ছিল লোক দেখানো।
তাহসীনা রুশদীর বলেন, ওই সময় বিএনপির পাঁচ দিন হরতাল ছিল। বিএনপির সে হরতাল, আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্যই ছিল ওই আশ্বাস।
আজ সোমবার সকালে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর এসব কথা বলেন।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সভায় আরও বক্তব্য দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া। এ সময় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নিখোঁজ ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার আলীর সন্ধান দাবিতে বিএনপি ২০১২ সালের ২২ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পাঁচ দিন হরতাল ডেকেছিল। এর মধ্যে ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর। এর একদিন পর ২ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি সাক্ষাৎ করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে তাহসীনা রুশদীর আরও বলেন, ‘হরতাল চলাকালীন সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে কেউ একজন ম্যাসেজ করেছিল আমি যাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। দেখা করলে উনি এ বিষয়টায় সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। ম্যাসেজটা পেয়ে আমি দেখা করেছিলাম এবং উনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে ওনার (ইলিয়াস আলী) ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং খুঁজে বের করবেন।’
তাহসীনা বলেন, ‘বনানী দুই নম্বর রোডে আমার বাসা। আশপাশের সিকিউরিটি গার্ড, ডাব বিক্রেতা ছিল। ওই সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে ছিল, যার কথা সংবাদমাধ্যমেও এসেছিল। ধস্তাধস্তি দেখে উনি যখন গাড়ির সামনে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁকে আইন প্রয়োগকারী একটি সংস্থার কার্ড শো করা হয়েছিল যে তারা আইনের লোক।’
আক্ষেপ প্রকাশ করে তাহসীনা রুশদীর বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা অনেকবার তাদের বাসায় এসেছে, অনেক দিন সিসি ক্যামেরাও লাগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেটা তদন্তের জন্য নয়। সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিল বাসায় কারা কারা যাতায়াত করে সেটি দেখার জন্য। তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস আলী গুমের পর কোনো একজন মানুষকে উনারা থানা নিয়ে গেছেন, বা কোথাও নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, এ রকম কোনো ঘটনা আমরা দেখিনি। তারা নির্লিপ্ত ছিল। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য ছিল খুবই মর্মান্তিক এবং পরিহাসমূলক।’
তাহসীনা রুশদীর অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা ইলিয়াস আলীকে গুম করার ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার ছাপিয়ে তারা ইলিয়াস আলীকে একজন খারাপ লোক হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
স্বামী নিখোঁজের পর গত ১০ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তাহসীনা রুশদীর। তিনি বলেন ‘এই সরকার আমাদের নামের সঙ্গে একটি পরিচয় জুড়ে দিয়েছে। সেটি হলো আমরা গুম পরিবারের সদস্য। এই গুম পরিবারের সদস্য বলে অফিস-আদালত, দেশের যেখানেই যাই কেন, মানুষ আমাদের এভাবেই দেখে। মানুষ ভয়ে কথা বলতে চায় না।’
তাহসীনা বলেন, ‘গুম হচ্ছে সরকারের পরিকল্পিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী যারা মাঠের কর্মী, যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে, তাদের গুম করা হয়েছে-যাতে এর মাধ্যমে একটি ম্যাসেজ দেওয়া যে স্টপ হয়ে যাও। এগোলেই তোমারদের গুম করা হবে, খুন করা হবে। এ ধরনের একটি ভীতি সঞ্চার করেছিল, যাতে এই সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে না পারে, কেউ আন্দোলন করতে না পারে।’
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন করে বলে মন্তব্য করেন তাহসীনা রুশদীর। তিনি বলেন, একটি বিনা ভোটের নির্বাচন, আরেকটি ভোট ডাকাতির নির্বাচন। এই দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে তারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে ছিল। এটাতে তারা সফল হয়েছে। কিন্তু এভাবে কত দিন, সবকিছুরই তো একটা শেষ আছে।
তাহসীনা রুশদীর বলেন, ‘সরকার অন্ধ হয়ে গেছে। গুমকে শিকার করতেই চায় না। কিন্তু অন্ধ হলেই তো প্রলয় বন্ধ হয় না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, সেই দিন পর্যন্ত আল্লাহ যেন আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন। যেদিন এ সরকারের পতন দেখতে পারি এবং গুমের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারটা যেন দেখে যেতে পারি।’