রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি থেকে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লোপাট হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অন্তত ২০ বিভাগ ‘ইউজার ফি’র নামে এই অর্থ হাতিয়ে নেয়। বিষয়টি নজরে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা আদায়ে ৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে অবৈধভাবে নেওয়া অর্থ আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রাপ্য ‘বিল’ বণ্টন স্থগিত রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ওই নির্দেশনার পরও কিছুদিন আগে দুটি বিভাগ সোয়া ২ কোটি টাকা গোপনে তুলে নিয়েছে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে আরও বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের লাগামহীন কর্মকাণ্ডের বিষয়টি উঠে এসেছে। ৩ লাখ টাকার বেশি কেনাকাটা হলে তা কেন্দ্রীয়ভাবে দরপত্র আহবানের কথা। ‘হেড অব প্রকিউরমেন্ট এনটিটি’ (হোপ) হিসাবে উপাচার্যের মাধ্যমে এই অঙ্কের কেনাকাটা করতে হবে। কিন্তু বিভাগগুলো নিজেরাই কাজটি করছে। আবার কর্তৃপক্ষ মেশিন ও রিএজেন্ট (পরীক্ষার রাসায়নিক) নিজেরা কিনলে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় কমে যায়। এতে ফির হারও কমানো সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সৌজন্য হিসেবে মেশিন নেওয়া হয় তাদের রিএজেন্ট ব্যবহারের শর্তে। পরে তাদের থেকে বেশি দামে তা (রিএজেন্ট) কিনতে হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন পরীক্ষার ফি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। মূলত অধিক কমিশনের লোভই কাজ করছে এখানে।
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউজার ফি সংক্রান্ত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন তাতে মুনাফার ৩০ ভাগ সংশ্লিষ্টরা নিতে পারবেন। তার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। মামলা চলমান থাকায় বাড়তি নেওয়া অর্থ আদায় করা যায়নি। অন্যদিকে মামলা চলমান থাকা সত্ত্বেও দুটি বিভাগ যে অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে, সেটি সঠিক হয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখতে হবে। বৈধ না হলে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, ২০০৭ সালে সিন্ডিকেটের একসভায় ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং বিভিন্ন অপারেশন কার্যক্রমের আয় থেকে লাভের ৩০ শতাংশ শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আনুতোষিক হারে বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে রিএজেন্ট ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কেনাকাটায় ব্যয়ের অর্থ বাদ দিয়ে লাভ হিসাব করার কথা।
পরে ২০১৮ সালে সিন্ডিকেটের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, গৃহীত পারিতোষিক ব্যক্তির ২টি মূল বেতনের বেশি হবে না এবং প্রতিমাসে মোট আয়ের ১০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেবে। এই অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের (যেসব বিভাগ ৩০ শতাংশ নেয় তাদের বাদ দিয়ে) বছরে এক বা দুটি ইনসেনটিভ দেওয়া হবে।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই সুবিধাভোগীদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। মামলার রায় বিচারপ্রার্থীদের পক্ষে যায় বলে জানা যায়। সে কারণে তারা ইউজার ফি হিসেবে ৩০ শতাংশ অর্থ নেওয়ার এখতিয়ার লাভ করেন। কিন্তু আদেশে খরচ বাদ দিয়ে কেবল মুনাফার ৩০ শতাংশ নেওয়ার কথা।
এ অবস্থায় মামলার রায়ের পরে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অফিস আদেশ জারি করে। তাতে মোট সাতটি নির্দেশনা আছে। এগুলো হচ্ছে-নিট লাভের ৩০ ভাগ ইউজার ফি নেওয়া যাবে; এটি যারা নেবেন, তারা প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন না; সংশ্লিষ্টরা স্ট্যাম্পে হলফ করে প্রাইভেট প্রাকটিস করেন কিনা তা ৭ দিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন; গৃহীত ইউজার ফি থেকে ট্যাক্স কাটা হবে; ২০০৭ সাল থেকে যারা নিট লাভের পরিবর্তে মোট আয়ের ওপর এই ফি নিয়েছেন, তারা অতিরিক্ত (নেওয়া) অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে ফেরত দেবেন; সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো প্রতি আর্থিক বছরে লাভ-ক্ষতি ও মুনাফা নির্ধারণ করবেন; অতিরিক্ত নেওয়া অর্থ নির্ধারণ ও আদায় (জমা) না হওয়া পর্যন্ত ইউজার ফি খাতে বিল বণ্টন স্থগিত থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিভাগের নথি বলছে, ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত ২০টি বিভাগের শিক্ষক ও কর্মচারীরা প্রাপ্যতার বাইরে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮২ টাকা বেশি গ্রহণ করেছেন। বিভাগগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সার্জারিসহ অন্যান্য খাতে এই সময়ে ৭৫২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা আয় হয়েছে। ব্যয় আছে ৪২৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
ফলে নিট লাভ হয়েছে ৩২৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী লাভের ৩০ শতাংশ সংশ্লিষ্টরা কমিশন হিসেবে নেবেন, কিন্তু সরকারি ট্যাক্স বাবদ ১০ শতাংশ কেটে রাখার পরে। ৩০ শতাংশ কমিশনে আসে ৮৩ কোটি ৮৩ লাখ ১১ হাজার টাকা। ১০ শতাংশ আয়কর আসে ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ফলে সংশ্লিষ্টদের প্রাপ্য ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১৩০ টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তহবিল থেকে নিয়েছেন ২০৩ কোটি ৩২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা।
এদিকে গৃহীত অতিরিক্ত অর্থ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের ইউজার ফি খাত থেকে কমিশন গ্রহণ বন্ধ রাখতে উচ্চ আদালতের আদেশ আছে। কিন্তু হেমাটোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগ আলাদাভাবে এখন পর্যন্ত ইউজার ফি খাতের দুই কোটি ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার ৫২৭ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। গত মার্চে কয়েক দফায় এসব অর্থ উঠানো হয়। উত্তোলন করা টাকা থেকে ৩০ লাখ খরচ করে পিকনিক করেছে হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসক-নার্সরা।
হেমাটোলজি বিভাগ দুই দফায় এক কোটি ১১ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ টাকা উত্তোলন করেছে। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগ ব্যাংক থেকে এক কোটি ২৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৬২ টাকা উত্তোলন করেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দীন শাহ এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবতোষ পালের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও মন্তব্য করতে রাজি হননি।