বিএনপি যেভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, এটা অব্যাহত থাকলে দলটির কর্মীরা নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে শুরু করবেন। তাঁরা বাধা উপেক্ষা করে পাল্টা হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারেন বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় বিএনপির আন্দোলন থামানোর উপায় খুঁজছে সরকারি দল।
দলীয় উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকার একাধিক সমাবেশে বিএনপির কর্মীরা লাঠি নিয়ে এসেছেন। সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন। বিএনপি আন্দোলনের নামে সহিংসতা করতে চাইছে, সেটা প্রমাণ করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন সরকারি দলের নেতারা।
তাই বিএনপির কর্মীদের লাঠি নিয়ে সমাবেশে আসার বিষয়টি সামনে আনা হবে। তাতে ‘সহিংসতা’ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুরোমাত্রায় বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
বিএনপি যেভাবে লাঠি নিয়ে মাঠে নামছে, তাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া হবে না।
আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
এ ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে থাকা পুরোনো মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি নতুন মামলায় গ্রেপ্তার–আতঙ্ক ছড়ানো হবে, যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপি আন্দোলন টেনে নিতে না পারে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এ–ও মনে করছেন যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না–নেওয়া নিয়ে বিএনপির ভেতর ভাঙা–গড়া শুরু হতে পারে।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে বিএনপিকে কর্মসূচি পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা আছে। ঢাকায় সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখা হচ্ছে। তবে সব কর্মসূচির ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। কোথাও ছাড়, কোথাও বাধা দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে। তবে ঢাকার আশপাশের কর্মসূচির ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি কঠোরতা দেখানো হচ্ছে। পুলিশকে গুলিও করতে হয়েছে। এরপরও বিএনপি কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টার চিন্তা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির কর্মসূচি থামাতে দলের নেতা-কর্মী ও পুলিশকে সুবিধামতো কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে সরকার সমালোচনায় পড়ছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। তাই বিএনপিকে সহিংসতার দায় দিয়ে চাপে ফেলা সবচেয়ে সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি সহিংস হওয়ার পর তাদের দমন করা সহজ হয়েছিল।
বিএনপি গত আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি দিয়ে আসছে। বিএনপি বলছে, গত ১ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সরকারি দল ও পুলিশের হামলায় বিএনপির পাঁচ নেতা-কর্মী নিহত এবং ২ হাজার ৭৬৮ জন আহত হয়েছে
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর হাজারীবাগে বিএনপির সমাবেশে তাদের নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল বাঁশ ও কাঠের ছোট ছোট লাঠি। কোনো কোনো লাঠির মাথায় ছিল ছোট আকারের জাতীয় পতাকা। তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন। এ সময় লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় নামলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে দুই পক্ষেরই বেশ কজন আহত হন। একপর্যায়ে পুলিশ দুই পক্ষের মাঝে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
ওই সংঘর্ষে আহত কর্মীদের দেখতে গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা নেতা–কর্মীদের দেখতে যান নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক গতকাল আহত নেতা–কর্মীদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, একটা সহ্যের সীমা আছে। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলে পরিণতি ভালো হবে না। দলগতভাবে বিএনপিকে মোকাবিলা করা হবে। হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
আহত নেতা–কর্মীদের দেখতে যাওয়া নেতাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি গতকাল প্র বলেন, দুজন পুরুষ, একজন নারী ও একজন সাংবাদিককে যেভাবে আহত করা হয়েছে, তা খুবই অমানবিক। তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগ মারামারি করছে না। বিএনপি সহিংসতার পথে যাচ্ছে। সেটা জনগণের কাছে উন্মোচন করবে আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্র জানায়, একদিকে বিএনপির আন্দোলনের চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও প্রকট। আগামী জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে তৃণমূলেও সম্মেলন চলছে। এতে বিভিন্ন স্থানেই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে শুধু দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখা যাবে কি না—এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করার উপায় খুঁজছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
বিএনপি গত আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি দিয়ে আসছে। বিএনপি বলছে, গত ১ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সরকারি দল ও পুলিশের হামলায় বিএনপির পাঁচ নেতা-কর্মী নিহত এবং ২ হাজার ৭৬৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে চারজন পুলিশের গুলিতে এবং একজন আওয়ামী লীগের হামলায় নিহত হন। এ সময়ে গ্রেপ্তার করা হয় ২৯৪ জনকে। মামলা করা হয়েছে ৭৫টি। এসব মামলায় মোট আসামি প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ৫ হাজার ৪৭০ নেতা-কর্মী।
গত বুধবার নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। তিন মাসব্যাপী এ কর্মসূচি শেষ হবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে। দলটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি টেনে নিতে চায়।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপি একদিকে সরকারবিরোধী সব দলকে এক কাতারে আনার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে সমাবেশের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করছে।
আগের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা আছে। এবার বিএনপিকে মাঠে নামার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি কীভাবে মাঠছাড়া করা যায়, সেই পরিকল্পনাও চলছে।
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করবে। তাদের কর্মসূচি অহিংস হলে সমস্যা নেই। তারা এর মধ্যে অনেক কর্মসূচি পালনও করেছে।
কিন্তু তারা যেভাবে এখন লাঠি নিয়ে মাঠে নামছে, তাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া হবে না। নিশ্চয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দেখবে।