স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণে বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে এখন ঢাকা। এমনকি বড় বড় পরাশক্তির ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এবং প্রভাব বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে লড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) এ বিষয়ে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা প্রকাশকারী ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোম্যাট। ম্যাগাজিনটি মূলত এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকেই বেশি ফোকাস করে। বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য প্রতিবেদনটি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাফী মো. মোস্তফা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে মার্কিন এবং চীনা কর্মকর্তাদের সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ১৪ জানুয়ারি দক্ষিণ ও মধ্য-এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করেন। সেসময় তিনি রাজনৈতিক দল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন।
আগের সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আবদুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি।
মোমেনের সঙ্গে লাউবাচারের বৈঠকের একদিন পর চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং বিমানবন্দরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, নবনিযুক্ত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত সেই সফরে দেশটির কূটনৈতিক ঐতিহ্য কার্যত ভেঙে গেছে। কারণ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রতি বছর আফ্রিকার কোনো দেশকে তাদের প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্যে পরিণত করার বিষয়ে দীর্ঘদিন চালু থাকা প্রথা মেনে আসলেও এ বছর নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে ঢাকায় আসেন।
যদিও কিন সেসময় আফ্রিকায় যাচ্ছিলেন এবং মোমেনের সঙ্গে বৈঠকটি কোনো সরকারি সফর ছিল না। তারপরও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশের রাজধানীতে সংক্ষিপ্ত বিরতি ও মাঝরাতে মোমেনের সঙ্গে বিমানবন্দরে তার সাক্ষাৎ ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই বিষয়টি ঢাকা ও বিদেশের কূটনৈতিক মহলের নজর এড়ায়নি।
কিনের সেই সফরের পরপরই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপ-প্রধান চেন ঝো-এর নেতৃত্বে সিসিপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। সফরে প্রতিনিধি দলটি ২০তম সিসিপি জাতীয় কংগ্রেসের স্পিরিট তথা মূল কথা ব্যাখ্যা করে নানা বক্তৃতা দেয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তা হলো- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। পররাষ্ট্রনীতির এই কৌশল বাংলাদেশের জন্য ভালো কাজ করেছে। তবে দিন যত যাচ্ছে বড় পরাশক্তিগুলো তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে ঢাকাকে ক্রমবর্ধমানভাবে চাপ দিচ্ছে।
২০২০ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে বিগান সেসময় ‘অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি… মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিককে এগিয়ে নিতে’ মার্কিন প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেন।
সেসময় তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এই অঞ্চলে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) কাজের কেন্দ্রবিন্দু হবে।’
বাংলাদেশকে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিকে কৌশলে টানতে যুক্তরাষ্ট্রের সেই প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চীন। ২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সতর্ক করে দেন, চার দেশের ছোট ক্লাব অর্থাৎ কোয়াড-এ বাংলাদেশ যোগ দিলে ‘চীনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।
যদিও চীন প্রায়ই বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়েছে, তারপরও বেইজিং এর উল্টো কাজটিও করে আসছে। চীন তার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) যোগ দিতে বাংলাদেশকে প্ররোচিত করছে।
এদিকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বাকযুদ্ধও চলছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোতে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছিলেন। তিনি সেসময় বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করছেন’।
এর আগে ঢাকায় অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ হিসেবে দাবি করা দেশগুলোর ‘আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার’ সমালোচনা করা হয়।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে, যারা নিজেদের ‘বিশ্বের শাসক’ বলে মনে করে সেই রাষ্ট্রগুলো অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কাজ করে চলেছে।’
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে পিটার হাসের ক্রমবর্ধমান নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সমালোচনামূলক এই বক্তব্য সামনে এসেছিল।
গত বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন পরিদর্শনের সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সাথে দেখা করেন। সেসময় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দেশে স্বচ্ছ নির্বাচনের আহ্বান জানান। বাংলাদেশে চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, ২০১৩ ও ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন ব্যাপক অনিয়মের জন্য বিশ্বব্যাপী সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল এবং এখনো উদ্বেগ রয়েছে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে না।
অতি সম্প্রতি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এক দশক ধরে নিখোঁজ বিরোধী দলের নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারকে দেখতে যান। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে।
আবার অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠা বিএনপি অর্থনীতিতে সরকারের ভুল ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই বিক্ষোভগুলো গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি বিশাল সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। তবে সেখানেও বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর ঢাকায় মহাসমাবেশের কয়েকদিন পর সুমনের বাসায় যান পিটার হাস।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সমালোচনার জবাবে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এক টুইট বার্তায় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।
রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি দিয়ে মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ চায় না রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান দেশটিকে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছে। ভূ-রাজনীতির অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ রবার্ট কাপলান ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘ভারত মহাসাগর হবে বিশ্বব্যাপী সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু’। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে শিপিং বা পরিবহনের রুট হিসেবে এর গুরুত্ব রয়েছে।
ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরে পরাশক্তিগুলোর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সারা বিশ্বেই সুবিদিত। ভারত মহাসাগর এবং এর বিভিন্ন উপসাগর দিয়ে আফ্রিকার সাথে চীনের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এছাড়া নিজেদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই অঞ্চলে চীনা উপস্থিতি বাড়ানোরও চেষ্টা করেছে বেইজিং। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে।