মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারে, পাল্টাতে পারে– এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে যাচ্ছে। আর গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটি সরকার আনতে চাচ্ছে, যার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। সেই ক্ষেত্রে কিছু বুদ্ধিজীবী সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাঁবেদারি ও পদলেহন করেন।
জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন সংসদ নেতা। পরে প্রধানমন্ত্রীর আনা সাধারণ প্রস্তাবটিও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে এ কথা বলেন, তখন ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। আটলান্টিক পার হলে কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিক্টেটরকে সমর্থন দিচ্ছেন? তখন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারিকে এই প্রশ্নটি করেছিলাম।
সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকেও বলি যে, দেশটা কথায় কথায় গণতন্ত্রের সবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কুদন করছেন, ওঠবস করছেন। উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ, তাঁরা যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারেন, পাল্টাতে পারেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো আরও বেশি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আরব বসন্তের নামে গণতন্ত্রের কথা বলে ঘটনা ঘটাতে গিয়ে এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্যাঁচে পড়ে গেছেন। যতদিন ইসলামিক দেশগুলোর ওপর চলছিল, ততদিন কিছু হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে এখন সারাবিশ্বই আজকে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে গেছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? কয়েক দিন আগের একটি কথা– আমেরিকার টেনেসিস রাজ্যে তিনজন কংগ্রেসম্যান অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন এবং বিক্ষোভ করেন। তাঁদের মধ্য থেকে দু’জনকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ তিনজন বিক্ষোভকারীর মধ্যে দু’জন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ এবং একজন শ্বেতাঙ্গ। এ কারণে তাঁদের পদ হারাতে হয়। এখানে মানবাধিকার কোথায়; গণতন্ত্র কোথায়– এটা আমার প্রশ্ন।
তিনি বলেন, আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় অস্ত্র নিয়ে স্কুলে ঢুকে যাচ্ছে। বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করছে। শিক্ষকদের হত্যা করছে। শপিং মলে ঢুকে যাচ্ছে, হত্যা করছে। ক্লাবে যাচ্ছে, সেখানে হত্যা করছে। এটা প্রতিদিনেরই ব্যাপার। কোনো না কোনো রাজ্যে অনবরত এই ঘটনা ঘটছে।
সংসদ নেতা বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকারী খুনি রাশেদ আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। দেশটিতে যত প্রেসিডেন্ট এসেছে, সবার কাছে আবেদন করেছি। আইনগত ও কূটনীতিকভাবে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনে বলেছি– এই খুনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি; তাকে আপনারা আশ্রয় দেবেন না। এরা শিশু হত্যাকারী; নারী, রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীর হত্যাকারী। এরা মানবতা লঙ্ঘনকারী। এদের আপনারা আশ্রয় দিয়েন না। ফেরত দেন। কই! তারা তো তাকে ফেরত দিচ্ছে না। খুনিদের লালন-পালন করেই রেখে দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা ছোট্ট শিশুর হাতে ১০টা টাকা দিয়ে তাকে দিয়ে একটা মিথ্যা বলানো। শিশুর মুখ থেকে কিছু কথা বলানো। কী কথা! ভাত-মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চাই। একটা ৭ বছরের শিশু, তার হাতে ১০টা টাকা তুলে দেওয়া এবং তার কথা রেকর্ড করে সেটা প্রচার করা– স্বনামধন্য এক পত্রিকা। খুবই পপুলার। নাম তার প্রথম আলো। কিন্তু বাস করে অন্ধকারে। প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু; প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু। প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়– এরা এই দেশে কখনোই স্থিতিশীলতা থাকতে দিতে চায় না।’
তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে যখন ইমার্জেন্সি হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা (প্রথম আলো, ডেইলি স্টার)। আদাজল খেয়ে নেমে গেল। বাহবা কুড়ালো। আর তার সঙ্গে আছে– একজন সুদখোর (ড. মুহাম্মদ ইউনূস)। বড়ই প্রিয় আমেরিকার। আমেরিকা একবারও জিজ্ঞেস করে না যে, গ্রামীণ ব্যাংক– এটি তো একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সরকারের বেতন তুলত যে এমডি, সে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে পেল যে, আমেরিকার মতো জায়গায় সামাজিক ব্যবসা করে; বিনিয়োগ করে দেশে-বিদেশে। এই অর্থ কোথা থেকে আসে? এটা কি জিজ্ঞেস করেছে কখনও তারা? জিজ্ঞেস করেনি। এদের কাছ থেকে দুর্নীতির কথা শুনতে হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ। এদের কাছ থেকে মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়। যারা গরিবের রক্তে চোষা টাকা পাচার করে; বিদেশে বিনিয়োগ করে নিজেরা শতকোটি টাকার মালিক হয়ে আবার আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়ে যায়। এই সব লোক এ দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আওয়ামী লীগ সরকার এসে কিছুই নাকি দেয়নি! দেশ নাকি ধ্বংস হয়ে গেছে!’
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেকেরই আপত্তি। আপত্তিকারীদের বোধ হয় অভিজ্ঞতার অভাব আছে। এই ৭০ অনুচ্ছেদই দেশে সরকারে স্থায়িত্বের সুযোগ এনে দিয়েছে। যার ফলে দেশটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ফ্লোর ক্রস করার কারণে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারেনি। এর আগে ১৯৪৬ সালেও একই খেলা হয়েছিল। যার কারণে পূর্ববাংলাটা যেভাবে গঠন হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি। পরে মার্শাল ল এসে ক্ষমতা দখল করে। কাজেই এই ৭০ অনুচ্ছেদেই গণতন্ত্রকে সংহত করতে সুরক্ষা দেয়। আর এর সুফল জনগণ পেতে পারে। তিনি বলেন, জানি না কেন কিছু কিছু সদস্যের এর ওপর এত রাগ! কারণ হচ্ছে, সরকার ভাঙতে-গড়তে বা খেলাটা খেলতে তারা সক্ষম হচ্ছে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। গণতন্ত্র, না উন্নয়ন– এই আলোচনা আসা ঠিক না। কেননা, অতীত অভিজ্ঞতা খুবই বিচিত্র। আইয়ুব আমল, ইয়াহিয়া, জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলও দেখা গেছে।
ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের দাবি করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি এবং দেশের মানুষ বিশ্বাস করেন, টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে বিরোধী দলকে বড় বিরোধী দল বলা হয়; তারা ২০০৮ সালে ২৯ আসন পেয়েছিল। যদি এত বড় বিরোধী দল হয়, তাহলে ২৯টি আসন পেল কেন? তারা এত বড় দল কোত্থেকে হয়ে গেল? আর সাজাপ্রাপ্ত আসামি সেই দলের চেয়ারপারসন। হত্যা-গুম-খুন-দুর্নীতি-জঙ্গিবাদ– সব কিছুতেই যারা পারদর্শী ছিল। তাদের জন্য মানুষ আতঙ্কে থাকত। এখন তাদের নিয়ে উৎফুল্লতা শুরু করছে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য।