বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে বিএনপি দেশের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করে সেই অর্থ দিয়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে।
আজ বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনা ও অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে তড়িঘড়ি করে আইন প্রণয়নের অভিযোগ নাকচ করে বলেন, এর প্রস্তুতি আগেই নেওয়া ছিল। ২০১৭ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন আমাদের সকলকে ডেকেছিলেন তখনই তিনি বলেছিলেন, আমাদেরও প্রস্তাব ছিল।
অনেক দিন থেকে মোটামুটি প্রস্তুত করে রেখেছিলাম।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে গত ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংলাপের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যখন ডায়ালগ করতে গেলাম তখন তিনি বললেন, বিলটা তাড়াতাড়ি পাসের বিষয়ে। তিনি (রাষ্ট্রপতি) চান এই বিলের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত হোক। এরপর বিল আমরা সংসদে নিয়ে আসলাম। কিন্তু প্রস্তুতি তো আমাদের বহু আগে থেকে ছিল। অন্য কোনো দল করেনি। আওয়ামী লীগ করল। এতে জনগণের ভোট সুরক্ষিত হল। গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করলাম।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমরা এই পার্লামেন্টে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিলটা পাস করতে পেরেছি। বিলে ২২টা সংশোধনী বিরোধী দলের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে জাতীয় পার্টির সংশোধনী, বিএনপির সংশোধনী, জাসদের সংশোধনী আমাদের ওয়ার্কার্স পার্টির সংশোধনী সকলের সংশোধনী আমরা গ্রহণ করেছি। তাতে এই বিল আর সরকারি বিল না, এটা বিরোধী দলে তৈরি করা বিল হয়ে গেছে। বিলটা সবার হয়ে গেল। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম সকলে বিলের ওপর বক্তব্য দিয়েছেন।
লবিস্ট নিয়োগ করে বিএনপির বিপুল অর্থ খরচ করার হিসাব নেওয়া হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশ সব থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি যাদের পছন্দ নয় তারাই শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের সর্বনাশ করছে। এতো বিপুল অর্থ কোথায় থেকে আসল, বিদেশে খরচ হল- এর জবাব ও ব্যাখ্যা বিএনপিকে দিতে হবে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে লবিস্ট নিয়োগের খরচের পাই পাই হিসাব নেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বাঁচানো, নির্বাচনকে বানচাল ও প্রশ্নবিদ্ধ করা, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য বিএনপি শত শত কোটি টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করে, কোনো ভাল কাজের জন্য নয়। এতো অর্থ বিএনপি কোথায় থেকে পেল, কীভাবে সেখানে গেল- এর জবাব একদিন বিএনপিকে দিতেই হবে।
নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি হচ্ছে দেশের জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করা, কেড়ে নেওয়া নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন তার বড় প্রমাণ। বিএনপি এই নির্বাচনেও নানা খেলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষাসহ সব কিছু আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল। তিনি আরো বলেন, এদের কোন দেশপ্রেম নেই, জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। তাই দেশের অগ্রযাত্রাকে বন্ধ করতে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে নানা চক্রান্ত করছে। বিএনপি দেশকে ধ্বংস করা, লুটপাট করা, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস সৃষ্টি করা ছাড়া, কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু দেশের জনগণের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে, কোন অপপ্রচার ও মিথ্যাচারে জনগণ বিভ্রান্ত হবে না। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই।
র্যাবের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা বলেন, যারা দেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ দমনে অত্যন্ত সফল ও পারদর্শীতা দেখিয়েছে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে- তারা এতো খারাপ হয়ে গেল কেন? তিনি বলেন, হলি আর্টিজানে যখন সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে, মানুষ হত্যা করে। নৃশংস দৃশ্য! তারা কেবল হত্যাই করেনি, ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মানুষ মেরেছে। পুলিশের দুজন অফিসার সেখানে ছুটে গেলে তাদের গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর আমরা পদক্ষেপ নেই। সে সময় আমেরিকার যিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি টুইট করেছিলেন- হলি আর্টিজেনের সন্ত্রাসী হামলা বাংলাদেশ একা সমাধান করতে পারবে না। রোজার দিন ছিল। সারারাত আমরা কাজ করেছি। সেহেরির সময় পর্যন্ত আমি বৈঠক করি। সবাইকে নিয়ে মিটিং করি। কী করা হবে। কীভাবে অপারেশন চালানো হবে। তার পূর্ণ পরিকল্পনা করেছি। পরের দিন সকাল নয়টার মধ্যে জিম্মিদের উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সফলতার সঙ্গে তাদের আক্রমণ মোকাবিলা করি। এর পরপরই আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর টুইটটি সরিয়ে ফেলেন। এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আর সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে পারেনি।
জনগণকে সম্পৃক্ত করে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যাদের তারা (যুক্তরাষ্ট্র) স্যাংশন দিল তাদের অধিকাংশ এই সন্ত্রাস দমনে ভূমিকা রেখেছিল। তাহলে এরা কেন আমেরিকার কাছে এত খারাপ হলো? সবচেয়ে ভালো ভালো অফিসার যারা। ওই অপারেশনে যারা ছিল। আমার মনে হয় যারা সন্ত্রাস দমনে সফল, যারা দেশটা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। যারা সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। সাধারণ মানুষের মানবাধিকার সুসংহত করেছে তাদের ওপরেই যেন আমেরিকার রাগ। আমি আমেরিকাকে দোষ দেই না। ঘরের ইঁদুর বাঁধ কাটলে কাকে দোষ দেবো?
সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে সংসদ নেতা বলেন, আজকের এই দিনে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করেছিল। সেই হত্যার সঙ্গেও বিএনপি জড়িত, সেটাও বেরিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর বিচারের কাজটি বারবার বাধা দিচ্ছে, তার পরিবার থেকে। যখনই বিচারের কাজটি শুরু হয় ওমনি তার পরিবার একটা বাধা দিয়ে রাখে। কেন ঠিক জানি না। তিনি বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর আমরা রিফিউজি হিসেবে ৬ বছর বাস করেছি দুই বোন। নাম পরিচয়টাও ব্যবহার করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল- সুযোগ পেলে দেশকে গড়ে তুলবো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে দেশে ফিরি। অনেক বাধা, বিপত্তি, অনেক অপপ্রচার শুনতে হয়েছে। লক্ষ্য স্থির করে চলেছি বলে লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনায় আমেরিকার আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। কিন্তু আমাদের এখানে কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে যায়নি। বরং দারিদ্র্য ৪০ ভাগ থেকে ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। বিশ্বাস করি আরো কমাতে পারবো। তিনি বলেন, সীমিত অর্থনীতির মধ্যেও আমরা বিনা পয়সায় করোনার পরীক্ষা করাচ্ছি। পাশাপাশি বিনা পয়সায় টিকাও দিচ্ছি। দেশবাসীকে আহ্বান জানাবো যারা ভ্যাকসিন নেননি, ভ্যাকসিন নেবেন। কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা ভ্যাকসিনের জন্য আলাদা বাজেট রেখেছি। ভ্যাকসিনের অভাব হবে না। যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তারা নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে মারা যাচ্ছেন না। সবাই টিকা নেবেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলবেন। যাতে ওমিক্রন থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারি।