চৌধুরী আলম। ঢাকার অন্যতম প্রভাবশালী কমিশনার। রাজধানীর কেন্দ্র গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ এলাকায় ছিল তার নিয়ন্ত্রণ। বিএনপি’র এই প্রভাবশালী নেতা সভা-সমাবেশে লোক জড়ো করতে পারতেন মুহূর্তেই। যে কারণে দলেও কদর ছিল তার। ২৪শে জুন, ২০১০। হঠাৎই উধাও হয়ে যান চৌধুরী আলম। খবর আসে ইন্দিরা রোড থেকে তাকে আটক করেছে ডিবি।পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান ডিবি কার্যালয়ে। কিন্তু হদিস পাননি তার। এখান থেকে সেখানে। খুঁজেছেন অনেক। পরিবার আজও খুঁজে পায়নি চৌধুরী আলমকে। কীভাবে নিখোঁজ হলেন তিনি, আছেনই বা কোথায়? পুরোটাই রহস্য। সম্প্রতি চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সায়ীদ চৌধুরী হিমু মানবজমিনের কাছে বলেছেন অনেক অজানা কথা। পড়ুন তার বয়ান-
সেদিন রাত ৮টার পর আবু সায়ীদ চৌধুরী হিমুর মোবাইলে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেন তাদের পারিবারিক গাড়িচালক জসীম। কাঁচুমাচু গলায় জিজ্ঞেস করেন, স্যারের (চৌধুরী আলম) খবর জানেন। হিমু পাল্টা প্রশ্ন করেন, না, কি হয়েছে? জবাবে চালক বলেন, স্যারকে মনে হয় ডিবি অ্যারেস্ট করেছে। গাড়িচালককে ফের প্রশ্ন করেন হিমু- তোমাকে কে বলেছে? গাড়িচালক উত্তর দেন, স্যার যে গাড়িতে ছিলেন ওই গাড়ির চালক অসীম জানিয়েছে। টিভিতে নাকি খবরটি দেখাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হিমু টিভি অন করেন। দেখেন- প্রতিটি টিভির স্ক্রলে প্রচার হচ্ছে- ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে কমিশনার চৌধুরী আলম ডিবি’র হাতে আটক। সঙ্গে সঙ্গে দুই নিকট আত্মীয় নিয়ে তিনি দ্রুত যান মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে। তখন ডিবি কার্যালয় থেকে জানানো হয়, চৌধুরী আলমকে ডিবি’র কোনো টিম আটক কিংবা গ্রেপ্তার করেনি। অন্য কোথাও খোঁজ নেন। সেখান থেকে দ্রুত ছুটে যান তেজগাঁও থানায়। তৎকালীন ওসি তাদের জানান, ‘চৌধুরী আলম গ্রেপ্তার হয়েছেন- এটা নতুন কোনো কাহিনী নয়। আপনারা টিভির হেডলাইন দেখছেন না’। তখন ওই ওসি তাদের পরামর্শ দেন- যেহেতু তাকে ইন্দিরা রোড থেকে আটক করা হয়েছে ওই এলাকাটি শেরেবাংলানগর থানার অধীনে, আপনারা সেখানে যোগাযোগ করেন। ফের তারা ছুটে যান শেরেবাংলানগরে। সেখান থেকেও জানানো হয়, চৌধুরী আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আবার ছুটেন শেরেবাংলানগরস্থ র্যাব-২ এর কার্যালয়ে। সেখান থেকেও পান হতাশার খবর। পিতার খোঁজে এভাবেই সারারাত হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে। আটকের বিষয়টি স্বীকার করেনি কেউই। তখনো তারা আঁচ করতে পারেননি কী ঘটতে চলেছে। পরদিন প্রায় সবক’টি জাতীয় দৈনিকে ‘চৌধুরী আলম ডিবির হাতে গ্রেপ্তার’ শিরোনামে খবর ছাপা হয়। সংবাদপত্রের খবর দেখে তারা কিছুটা ভরসা পান।
এদিকে ঘটনার পরদিন সকালে তিনি খবর পান, কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবনের উল্টোদিকে রাস্তার পশ্চিম পাশে যে গাড়ি থেকে চৌধুরী আলম নিখোঁজ হয়েছিলেন সেই প্রাইভেট কারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে গাড়িটি শেরেবাংলানগর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
পিতার নিখোঁজের দিনের ঘটনার চিত্র তুলে ধরে হিমু বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে প্রথম হরতাল ডাকে বিএনপি। ২৫শে জুন ডাকা হরতালকে ঘিরে রাজধানীর শাহবাগ থানায় আগের দিনই বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। ওইদিন সকাল থেকেই রাজধানীতে শুরু হয় ধরপাকড়। দুপুরের দিকে শাহবাগ থানার এক এসআই আমাদের মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার বাসায় আসেন। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, স্যারকে বলবেন যেন সাবধানে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তার ওই মেসেজ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পিতাকে ফোন করেন হিমু। পিতাকে জানান পুলিশ কর্মকর্তার ওই সতর্কবার্তা। একইসঙ্গে বাসায় আসতে বারণ করেন, নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে চৌধুরীপাড়ার বাসায় যান চৌধুরী আলম। নিজের গায়ের পোশাক পরিবর্তন করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যান তিনি। ওই দিন চৌধুরী আলম ব্যবহার করেন ইন্দিরা রোডের ওই আত্মীয়ের গাড়ি। কাকতালীয়ভাবে ওইদিনই প্রথম তার আত্মীয়ের গাড়ির চালক নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাত ৮টার কিছু সময় পরই দুঃসংবাদটি পান হিমু। পরদিন তিনি ইন্দিরা রোডের কালিন্দি অ্যাপার্টমেন্টের গলির দুর্ঘটনাস্থলে যান। কথা বলেন প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। ঘটনাস্থলের পাশের ভবনে দায়িত্বরত এক নিরাপত্তারক্ষী তাকে জানান, ঘটনার সময় তিনি গেটেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাত ৮টার দিকে একটি হলুদ রঙের ট্যাক্সিক্যাব প্রথমে চৌধুরী আলমকে বহনকারী প্রাইভেট কারটিকে পেছন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেয়। তখন চালক গাড়ি থেকে নেমে ক্যাবচালকের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। গাড়িতে বসেই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন চৌধুরী আলম। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসেন তিনি। ঘটনার মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন। তখন তাদের গাড়ির ঠিক সামনেই ছিল কালো গ্লাসের সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস। গাড়িটির দুইপাশ থেকেই দরজা খোলা। মাইক্রোবাস থেকে চার-পাঁচজন সাদা পোশাকের লোক নেমে আসেন। তাদের একজন চৌধুরী আলমের গাড়িচালক অসীমকে চড়থাপ্পড় দিয়ে তাড়িয়ে দেন। বাকিরা চৌধুরী আলমকে টেনে-হেঁচড়ে কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করেন। এসময় মিনিটখানেক তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে চৌধুরী আলমকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলেন অপহরণকারীরা। দ্রুত গাড়িটি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পেছন পেছন অপহরণকারীদের একজন চৌধুরী আলমের গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যান।
এদিকে ঘটনার দুই-তিনদিন পর ডিবি অফিসের এক কর্মকর্তা হিমুকে জানান, উনি (চৌধুরী আলম) আছেন। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়টি প্রকাশ করছি না। এরপর কেটে যায় আরও কয়েকদিন। ফের যোগাযোগ করি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে। হতাশাজনক খবর দেন তিনি। নিভে যায় আশার প্রদীপ। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাড়তে থাকে উৎকণ্ঠা। তাদের সান্ত্বনা দিতে চৌধুরীপাড়ার বাসায় যান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
ওদিকে কোথাও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না পেয়ে বাধ্য হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। চৌধুরী আলমের সন্ধান দাবিতে সরকারের কাছে আবেদন জানান সন্তানরা। তাতে পাননি আশানুরূপ কোনো ফল। চৌধুরী আলম নিখোঁজের ৬ দিন পর ৩০শে জুন শেরেবাংলানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন হিমু। পরে সাধারণ ডায়েরিটি অপহরণ মামলা হয়। মামলার তদন্তভার দেয়া হয় ডিবিকে। তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিবি কর্মকর্তারা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন চৌধুরী আলমের পরিবারের সদস্যদের। বছর দুয়েক পর মামলার তদন্তভার যায় সিআইডিতে। তারাও একইভাবে ইন্টারোগেশন করেন পরিবারের সদস্যদের। শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তের দায় এড়ান তারা। উদ্ধারের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।
তদন্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে চৌধুরী আলম পুত্র বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের ভবনের সিসিটিভির ফুটেজ ছিল। এ ছাড়া চৌধুরী আলমের যে গাড়িটি উদ্ধার হয়েছে সেটির স্টিয়ারিংয়ে অপহরণকারীদের হাতের আঙুলের ছাপ ছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা সেই আলামতের কোনো কিছুই কেন সংগ্রহ করেননি? এ ছাড়া যে ট্যাক্সিক্যাবটি ধাক্কা দিয়েছিল সেটির মালিক কে তা বের করার চেষ্টা করেননি। উল্টো দফায় দফায় পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করেছেন তারা।
হিমু বলেন, আমার বাবা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নং ওয়ার্ডে (বর্তমান ২০ নং ওয়ার্ড) একটানা ২৩ বছর কমিশনার ছিলেন। আন্দোলনের তীর্থভূমি গুলিস্তান, পল্টন, মুক্তাঙ্গন, প্রেস ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এলাকায় ছিল তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। দলীয় যেকোনো কর্মসূচিতে মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি ২০ হাজার মানুষের সমাগম করতে পারতেন। দলীয় সভা-সমাবেশ কিংবা যেকোনো আন্দোলন কর্মসূচি সফলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন তিনি। সে কারণেই হয়তো চৌধুরী আলমকে প্রথম টার্গেট করা হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরির কারণে তাকে গুম করা হয়েছে।
পিতার সহজ-সরল জীবন-যাপনের কথা তুলে ধরে হিমু বলেন, পাকিস্তান পিরিয়ডে পিতার চাকরির সুবাদে নোয়াখালীর কবিরহাট থেকে রাজধানীর মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায় সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস শুরু করেন চৌধুরী আলম। স্থানীয়দের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে এলাকার বিচার সালিশের মধ্যমণি হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৫ সালে জড়ান বিএনপি’র রাজনীতিতে। নির্বাচিত হন ৫৬ নং ওয়ার্ডের কমিশনার। অনেক নরম মনের মানুষ ছিলেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করতেন। কখনো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। নিখোঁজের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও চৌধুরী আলমের জন্য বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করেছেন। এমন একটি চরিত্রের মানুষ কখনো গুম কিংবা অপহরণের শিকার হবেন- সেটা পরিবারের কেউ এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এখনো তারা আশায় বুক বেঁধে আছেন- একদিন চৌধুরী আলম পরিবারের কাছে ফিরে আসবেন।
তিনি আরও জানান, ওয়ান-ইলেভেনের পর চৌধুরী আলমের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা দায়ের হয়। ওই সময় গ্রেপ্তার হয়ে টানা ২৭ মাস কারাভোগ করেন তিনি। কারাগার থেকে যখন বের হন তখন তার বয়স ছিল ৬৭। এরপর বেশিদিন পরিবারের সান্নিধ্যে কাটাতে পারেননি। শিকার হন গুমের। চৌধুরী আলম রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হলেও ভাতা কিংবা কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান না তার পরিবার।
এদিকে স্বামী শোকে অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন স্ত্রী হাসিনা আক্তার। পিতার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন জ্যেষ্ঠ পুত্র হিমু। দুই কন্যা মাহফুজা আক্তার মনিকা ও মাহমুদা আকতার মুক্তা স্বামীর সংসারে রয়েছেন। কনিষ্ঠ পুত্র আবু সাদাত চৌধুরী শাওনও রাজনীতিতে জড়াননি। সামলাচ্ছেন ব্যক্তিগত ব্যবসা। চৌধুরী আলমের রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখভাল করতেন তার ছোট ভাই খোরশেদ আলম চৌধুরী মিন্টু। চৌধুরী আলম নিখোঁজের পর তাকে পাঁচ দফায় গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে নেয়া হয় বারবার। অন্তত ভাইয়ের লাশটা হলেও ফেরত চান তিনি।