সিনেমার গল্প বা রূপকথাকেও হার মানায় এমন জীবন তার। হতদরিদ্র ঘরে জন্ম। ছিলেন রিকশাচালক। ছিঁচকে চুরির অভিযোগও ছিল। কিন্তু সেসবই এখন অতীত। তার নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক এবং নেতা। সিনেমায় বিনিয়োগ সূত্রে গ্ল্যামার জগতেও ছড়িয়েছেন নামডাক। তার পুরো নাম সেলিম ওরফে সেলিম খান।
তিনি একাধারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ঠিকাদার, প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা। মেঘনায় অবৈধ ড্রেজিং আর একচেটিয়া বালু ব্যবসায় তিনি এখন শতকোটি টাকার মালিক। ঢাকার ক্যাসিনো থেকে শুরু করে আন্ডারওয়ার্ল্ডেও আছে হট কানেকশন। জমি দখলেও সিদ্ধহস্ত। সূত্র বলছে, ২০১১ সালে তিনি চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, এরপর থেকে এ পদেই আছেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির জোয়ার তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। অর্থবিত্ত আর বিলাসী জীবন অনেকটা স্বেচ্ছায় ধরা দেয় তার কাছে।
মেঘনায় বালু সন্ত্রাস : ৩১ জানুয়ারি বেলা ১১টা। সরেজমিন সেলিমের বালু সাম্রাজ্য দেখতে মেঘনার পারে হাজির যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম। কিন্তু পার থেকে পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। নদীর বুকে দু-একটি বলগেটের আনাগোনা ছাড়া দেখা যায় না তেমন কিছুই। আসল চিত্র আরও গভীরে। একেবারে নদীর মাঝ বরাবর। ডাকাতিয়া-পদ্মা-মেঘনা-তিন নদীর মোহনায় বিশেষ বাঁধ ‘মুলহেড’। সেখান থেকে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ভাড়া করা ট্রলার চলতে শুরু করে। নদীপথে ৪০ মিনিট যাওয়ার পর দৃশ্যমান হয় সেলিমের বালু সাম্রাজ্য। সারি বেঁধে ভাসমান ড্রেজারের লাইন দেখা যায়। বাতাসে উড়ছে কালো ধোঁয়া। ৫০টির মতো ড্রেজার ভাসছে নদীতে। পাইপ দিয়ে টেনে আনা হচ্ছে বালু। ফেলা হচ্ছে নোঙর করা বলগেটের চেম্বারে। ভাসমান ড্রেজারগুলোর গায়ে সেলিম চেয়ারম্যানের ছেলের নাম লেখা। ‘শান্ত খান ড্রেজিং প্রকল্প’-১, ২, ৩… ১৫, ২০ ইত্যাদি।
জানা যায়, একেকটি বলগেটে বালু ধারণক্ষমতা ৫ থেকে ১৫ হাজার ঘনফুট। প্রতি ঘনফুটের দাম ৩ টাকা। সে হিসাবে ৫ হাজার ঘনফুটের একটি বলগেট থেকে আয় ১৫ হাজার টাকা। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুশ বলগেট বালু। ফলে একচ্ছত্র বালু সাম্রাজ্য থেকে তার দৈনিক গড় আয় ৫০ লাখ টাকারও বেশি।
ড্রেজিং এলাকার ছবি তোলার জন্য আরেকটু কাছে যেতে চাইলে রাজি হলেন না ট্রলারচালক। কারণ নদীতে সেলিম চেয়ারম্যানের নিরাপত্তা টহল আছে। সন্দেহজনক কাউকে পেলে শুরু হয় মারধর। মোবাইল কেড়ে নিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হয় নৌযান। এ কারণে সাধারণ নৌযানগুলো ভয়ে তটস্থ।
স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে বালু তোলায় আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। সদর উপজেলার রাজ রাজেস্বর ইউনিয়নের বিশাল অংশ ইতিমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি তীব্র ভাঙনে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে শহর রক্ষা বাঁধও। ব্যাহত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন। জলজ পরিবেশ এবং প্রাণ প্রকৃতির ক্ষতি হিসাবের বাইরে।
প্রাসাদোপম বাড়ি : চাঁদপুর শহর থেকে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ছেড়ে কিছুদূর এগোলেই লক্ষ্মীপুর বাজার। সরু রাস্তার একদিকে চোখে পড়ে প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। বামদিকের ঢালে নামতেই প্রাসাদোপম এক বাড়ি। দুপাশে কারুকার্য খচিত বিশালাকার পিলারের মাঝে সিংহদুয়ারের আদলে লোহার তোরণ। ভিন্ন রকমের স্থাপত্য নকশা। দোতলা বাড়ির মূল কাঠামো বিশালাকার দুটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে। ইউরোপীয় ডিজাইনে তৈরি ঢেউ খেলানো ছাদ। বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরের একদিকে নির্মিত হচ্ছে যন্ত্রচালিত পানির ফোয়ারা এবং অন্যদিকে সুইমিং পুল।
পথচারীদের কয়েকজন জানান, এখানে কেউ থাকে না। সেলিম চেয়ারম্যান মাঝে মধ্যে আসেন নির্মাণ কাজ তদারক করতে। বাড়ির পূর্ব পাশে গাড়ি বারান্দায় একটি র্যাব-৪ মডেলের জিপ (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৬৪৬৩) পার্ক করা। কাচের ওপর লেখা ‘ভয়েস, প্রেস’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেলিম চেয়ারম্যানের ব্যবহৃত গাড়ির সবই ‘প্রেস’ লেখা। কারণ তিনি স্থানীয় একটি পত্রিকা কিনেছেন। এছাড়া ‘ভয়েস টিভি’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে তার।
অঢেল সম্পদ : চাঁদপুর এবং ঢাকায় সেলিম চেয়ারম্যানের অঢেল সম্পদের খোঁজ মেলে। লক্ষ্মীপুর বাজারে তৈরি হচ্ছে মার্কেট। নাম-‘সিনেবাজ লিমিটেড মার্কেট’। ইতোমধ্যে দোকান পজেশন বিক্রি ও ভাড়া দেওয়া শুরু হয়েছে। সাইনবোর্ডে দেওয়া নম্বরে ফোন করা হলে একজন জানান, এখন শুধু দোকান ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সিঙ্গেল দোকানের পজেশন ভাড়া ৩ হাজার এবং ডাবল ৫ হাজার। বেশিরভাগই ইতোমধ্যে ভাড়া হয়ে গেছে।
এছাড়া চাঁদপুরের কালীবাড়ি মোড়ে কিনেছেন আসলাম ম্যানসন (লাভলী স্টোর), ওয়ান মিনিটের মোড়ে সুভাষ চন্দ্র রায়ের বাড়ি কিনেছেন ৪ কোটি টাকায়। শহরের টাউন হল মার্কেটের ৪, ৫ এবং ৬ তলা লিজ নেওয়া হয়েছে। ইচলি চুন ফ্যাক্টরির পাশে মেয়ের নামে কিনেছেন ৭০ শতাংশ মূল্যবান জায়গা। লক্ষ্মীপুর মৃধাবাড়িসংলগ্ন নদীর পাড়ে প্রায় ২শ একর জায়গা ব্লক ফেলে দখল করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার কাকরাইলে আছে ৪ তলা বাড়ি। নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড় এলাকায় ১০ তলা ভবন। সেলিমের হাতে রয়েছে দুটি লাইসেন্সকৃত পিস্তল এবং শটগান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেলিম খান লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হলেও বেশিরভাগ সময় থাকেন ঢাকায়। রাজধানীর রাস্তায় চলাফেরা করেন গাড়িবহর সহযোগে। কোটি টাকার ল্যান্ড ক্রুজার জিপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মডেলের একাধিক গাড়ি রয়েছে তার। বড় ছেলে শান্ত খান, মেয়ে পিংকি এবং মেয়ের জামাইসহ পরিবারের সদস্যদের সবাই বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। সর্বশেষ তিনি এক মাস আগে একটি বিলাসবহুল রেঞ্জ রোভার জিপ কিনেছেন। এছাড়া ঢাকার সিনেজগতে তার বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। তার মালিকানাধীন শাপলা মিডিয়া এখন দেশের সবচেয়ে বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে নির্মিত ছবির সংখ্যা ৭টি। আরও ১০০ ছবি নির্মাণের চমকপ্রদ ঘোষণা দিয়েছেন সেলিম খান।
জমি কেলেঙ্কারি ফাঁস : চাঁদপুরে প্রস্তাবিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ কেলেঙ্কারি সম্প্রতি ফাঁস হলে নতুন করে আলোচনায় আসে সেলিম চেয়ারম্যানের নাম। সরকারি অর্থ লুটের অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা জানাজানি হলে হৈচৈ পড়ে যায়। তদন্তে নামে মাঠপ্রশাসন। এতে বেরিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক সেলিম। অন্তত ৬২ একর জমি রয়েছে তার পরিবারের নামে। মৌজা মূল্যের অন্তত ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে এসব জমি সরকারের কাছে বিক্রির চেষ্টা করা হয়।
জানা যায়, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে বিস্তীর্ণ এলাকায় জমি দখলের উৎসব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। অস্ত্রের মুখে অসংখ্য লোকের জমি লিখে নেওয়া হয়েছে। যারা রাজি হননি তাদের ভিটে ছাড়তে হয়েছে। অনেকে জমি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছেন বিনা পয়সায় অথবা নাম মাত্র মূল্যে।
সরেজমিন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে খোঁজ নিতে গেলে অসংখ্য ভুক্তভোগীর খোঁজ মেলে। যাদের অনেকেই ভিটে ছাড়া। দখলের শিকার অন্তত ২০ জন ভুক্তভোগীর নাম আসে যুগান্তরের হাতে। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন-সোবহান ভূঁইয়া, নেসার মুন্সি, আজিজ রারি, ইদ্রিস আকন, সেলিম গাজি, হানিফ খান, নুরুল ইসলাম, শাহ আলম খান, মিজান খান, মিলন গাজী, মোস্তফা মুন্সি, করিম পাটোয়ারী, শাহদাত গাজী এবং হাবিব মুন্সি। দখলের সময় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় রাজন খাঁ ও মিজান খাঁর বাড়ি।
জানা যায়, জমি দখলের শোকে হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। জাহাঙ্গীরের ভাই জাকির হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ কার কাছে করব। হাজার হাজার লোকের জমি নিয়ে গেছে সে (সেলিম চেয়ারম্যান)। কিন্তু কেউ মুখ খুলবে না।’
সেলিমের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি দলীয় কর্মীরাও। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক সফিকুর রহমান গাজী বলেন, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদে তিনি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ কথা শুনে ক্ষিপ্ত হন সেলিম খান। নানাভাবে তাকে হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে শহরের হাকিম প্লাজার সামনে অতর্কিত হামলা হয় তার ওপর। ধারালো অস্ত্রের আঘাত এবং বেধড়ক পিটুনিতে গুরুতর আহত হন তিনি। এ নিয়ে মামলা চলছে।
এদিকে জমি কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হলে সেলিম চেয়ারম্যান গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। ইতোমধ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তরফে তাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সেলিমের বক্তব্য : অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সেলিম খান বুধবার কাকরাইলে তার প্রযোজনা সংস্থা শাপলা মিডিয়ার অফিসে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত। তিনি বলেন, তার সব সম্পদ আয়কর ফাইলে প্রদর্শিত। তিনি পরপর ২ বার চাঁদপুরে শ্রেষ্ঠ করদাতার সম্মাননাও পেয়েছেন। বৈধ ব্যবসা করেন তিনি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সদস্য।
সেলিম চেয়ারম্যান আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ জমি বিক্রেতা রেজিস্ট্রি অফিসে সশরীরে উপস্থিত থাকেন। স্বেচ্ছায় যারা জমি রেজিস্ট্রি দিয়েছেন তারা কেউ দখলের অভিযোগ করলে তা সঠিক হবে না। ড্রেজিং এবং বালু সন্ত্রাসের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি অনুমোদন অনুযায়ী তিনি প্রায় ৩১ কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম বালু তুলছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ খণ্ডন করে সেলিম বলেন, বাংলাদেশের কোথাও মৌজা মূল্যে জমি বিক্রি হয় না। কারণ ২০১৫ সাল থেকে মৌজা মূল্য বাড়ে না। তারপরও বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। উচ্চ আদালত এ বিষয়ে যে ফয়সালা দেবেন তা তিনি মাথা পেতে নেবেন। সন্ত্রাসের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে থানা পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। প্রাসাদোপম বাড়িটি আসলে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের জন্য। আশপাশের জমি তিনি ফিল্ম সিটি করার জন্য কিনেছেন।
সেলিম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জমি দখল এবং নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পৌরসভার সাবেক মেয়র নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ দলটা রক্তে গড়া। দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। এ সুযোগে কিছু অসৎ লোক দলে ঢুকে পড়েছে। তবে এরা বেশিদিন টিকবে না। অচিরেই আগাছা-পরগাছা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আবু নাইম পাটোয়ারী দুলাল বলেন, সেলিম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তার কারণে ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোণঠাসা। বদনাম হচ্ছে দলের। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে।