গুলবাদিন নাইবের খাটো লেন্থের ডেলিভারিতে মিড উইকেটে পুল করে দিলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। বল চলে গেলো বাউন্ডারির বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন নন স্ট্রাইকে থাকা মেহেদি হাসান মিরাজ।
তার বাঘের মতো গর্জন করারই কথা। মাত্র ৪৫ রানে ৬ উইকেট পতনের পর ব্যাট হাতে বীরের মত লড়াই করে দলকে ৪ উইকেটের অবিশ্বাস্য জয় এনে দেয়ার পর এমন উল্লাস-গর্জন শুধু তাদের পক্ষেই মানায়।
২৮ রানে ৫ উইকেট, ৪৫ রানে নেই ৬ উইকেট। একে একে ফিরে গেলেন তামিম, লিটন, মুশফিক, ইয়াসির রাব্বি, সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের পুরো শক্তিই বলতে গেলে শেষ হয়ে গেছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, কত কম রানে শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশ!
স্নায়ুর যুদ্ধ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের সমর্থকদের মনে। পরাজয়ের শঙ্কায় কেউ কেউ খেলা দেখাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের কাছেও হারতে হবে!
কিন্তু দুই তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজ এবং আফিফ হোসেন ধ্রুব যে বীরত্ব দেখালেন, তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সে একসঙ্গে খেলে নিজেদের মধ্যে এমন বোঝাপড়া তৈরি করেছেন তারা দু’জন, সেখান থেকে বাংলাদেশ দলকেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিলেন তারা।
১৭৪ রানের অবিশ্বাস্য এক জুটি গড়ে ৭ বল হাতে রেখেই ৪ উইকেটের এক অবিশ্বাস্য জয় এনে দিলেন বাংলাদেশকে। আফিফ অপরাজিত থাকলেন ৯৩ রানে এবং মেহেদী হাসান মিরাজ অপরাজিত থাকলেন ৮১ রানে। দুটি ইনিংসই নিজেদের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ইনিংস।
আফগানদের করা ২১৫ রানের ধ্বংসস্তুপের মুখে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়লেন মেহেদি হাসান মিরাজ ও আফিফ হোসেন ধ্রুব। দুজনের অবিচ্ছিন্ন ১৭৪ রানের রেকর্ড জুটিতে ৭ বল আগেই ম্যাচ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ৪ উইকেটের এ জয়ে তিন ম্যাচ সিরিজেও শুভসূচনা হলো বাংলাদেশের। এছাড়া বিশ্বকাপ সুপার লিগেও পাওয়া গেলো পূর্ণ ১০ পয়েন্ট। এখন ১৩ ম্যাচে ৯০ পয়েন্ট নিয়ে দুই নম্বরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। শীর্ষে থাকা ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ৯৫ পয়েন্ট।
২১৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ফজল হক ফারুকির করা প্রথম ওভারের শেষ দুই বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ইতিবাচক শুরু করেছিলেন তামিম ইকবাল। নিজের পরের ওভারেই ঘুরে দাঁড়ান ২১ বছর বয়সী এ পেসার। সেই ওভারের তৃতীয় বলে কট বিহাইন্ড হন লিটন দাস (৮)।
শেষ বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন অগ্রজ ওপেনার তামিম ইকবাল (১)। এ দুই উইকেটের একটিতেও আম্পায়ার প্রথমে আঙুল তোলেননি। তবে দুইবারই রিভিউ নিয়ে উইকেট তুলে নেয় আফগানরা। মিডল স্ট্যাম্পে পিচ করে হালকা ভেতরে ঢোকা বলে ব্যাটের ভেতরের কানায় লাগে লিটনের। প্রায় একই লেন্থ থেকে স্ট্যাম্পের লাইনে থাকা বল গিয়ে আঘাত হানে তামিমের প্যাডে।
দুই ওপেনারকে হারিয়ে শুরুর ধাক্কা কাটানোর মিশনে নেমে বিপদ আরও বাড়িয়ে সাজঘরে ফেরেন অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহিম (৩)। ফারুকির গুড লেন্থে পিচ করা ডেলিভারি ব্যাটে খেলতে পারেননি তিনি। বল আঘাত হানে প্যাডে। আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত জানান। রিভিউ নিয়েও নিজের উইকেট বাঁচাতে পারেননি মুশফিক, উল্টো খোয়া যায় একটি রিভিউ।
একই ওভারের শেষ বলে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড হয়ে যান অভিষিক্ত ইয়াসির আলি রাব্বি (০)। এই মাঠেই নিজের টেস্ট অভিষেকে প্রায় একইভাবে বোল্ড হয়েছিলেন ইয়াসির। তার বিদায়ে মাত্র ১৮ রানেই ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। দায়িত্ব বর্তায় সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কাঁধে। কিন্তু হতাশ করেন সাকিব।
মুজিব উর রহমানের করা অষ্টম ওভারের চতুর্থ বলে বোল্ড হন সাকিব। অফস্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বলে কাট করতে গিয়ে প্লেইড হন ১৫ বলে ১০ রান করা সাকিব। তার বিদায়ে পাওয়ার প্লে’র মধ্যেই পতন ঘটে ৫ উইকেটের। প্রথম দশ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ৩৯ রান।
অবশ্য এটিই রেকর্ড নয়। পাওয়ার প্লে’তে সর্বোচ্চ ৭ উইকেট হারানোর রেকর্ড রয়েছে খোদ আফগানিস্তানেরই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ১৭৬ রান তাড়া করতে নেমে ১০ ওভারেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল তারা। সেদিন আফগানরা অলআউট হয় ৫৮ রানে।
তবে বাংলাদেশের জন্য এটিই রেকর্ড। এর আগে ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ছয় ওভারের মধ্যে মাত্র ১৩ রানেই ৫ উইকেট হারিয়েছিল তারা। আজ ৮ ওভারের মধ্যে ২৮ রানে পড়লো ৫ উইকেট। বিপদ আরও বাড়ে ইনিংসের ১২তম ওভারে দলীয় ৪৫ রানের মাথায় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও (৮) সাজঘরে ফিরে গেলে।
মাত্র ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে তখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এক দল। সেখান থেকে যা হলো, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনাই বটে। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক তামিমও বলেছেন, ৪৫ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর ম্যাচ জেতার কথা ভাবেননি তিনি।
তবে বিশ্বাস রেখেছিলেন মেহেদি মিরাজ ও আফিফ হোসেন ধ্রুব। এ দুই তরুণ মিলে দেখেশুনে খেলতে থাকেন রশিদ খান, মুজিব উর রহমান, মোহাম্মদ নবীদের বিপক্ষে। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে, বাড়তি কিছুর চেষ্টা না করে, বল বাই বল এগুতে থাকেন এ দুই তরুণ।
আর তাতেই মিলেছে সাফল্য। ইনিংসের ১২তম ওভারে মাহমুদউল্লাহর উইকেট উদযাপনের পর আর খুশির উপলক্ষ পায়নি আফগানিস্তান। উল্টো সাগরিকায় উপস্থিত হাজার চারেক দর্শককে আনন্দে ভাসিয়েছেন মিরাজ ও আফিফ। উইকেটের চারদিকেই রান করেছেন তারা।
ইনিংসের ৩১তম ওভারে ৬৪ বল মোকাবিলায় ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি তুলে নেন আফিফ। মিরাজকে পঞ্চাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৬তম ওভার পর্যন্ত। ইয়ামিন আহমেদজাইয়ের বলে পুল করে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি তুলে নেন এ অফস্পিনিং অলরাউন্ডার।
ব্যক্তিগত মাইলফলক ছোঁয়ার পরেও নিজেদের কাজ শেষ ভাবেননি আফিফ-মিরাজ। বরং খেলেছেন আরও সতর্ক সাবধানী হয়ে। এরই মাঝে হয়ে যায় সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড। যা এতদিন ছিল ইমরুল কায়েস ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের দখলে, ১২৭ রান।
বাংলাদেশের রেকর্ড ভাঙতে পারলেও, শেষ পর্যন্ত ৩ রানের জন্য বিশ্বরেকর্ড ভাঙা হয়নি আফিফ-মিরাজের। শুরু যে ত্রাস ছড়িয়েছিলেন ফারুকি, শেষে তা ধরে রাখতে পারেননি। বরং তার করা ৪৮তম ওভারে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকিয়ে জয় আরও তরান্বিত করেন আফিফ ও মিরাজ।
পরে গুলবদিনের করা ৪৯তম ওভারের পঞ্চম বলে আসে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। শর্ট লেন্থের ডেলিভারিটি পুল করেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়েন আফিফ। তবে তার মধ্যে ছিল না উত্তেজনার লেশমাত্র। বরং নিজের কাজ যথাযথ করার তৃপ্তিই দেখা গেলো চোখেমুখে।
সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন মোস্তাফিজই। এছাড়া শরিফুল, সাকিব ও তাসকিনের শিকার ২টি করে উইকেট। কোনো উইকেট না পেলেও কিপটে বোলিংয়ে ১০ ওভারে ৩ মেইডেনসহ মাত্র ২৮ রান খরচ করেছেন মিরাজ। পরে ম্যাচ জেতানো ব্যাটিংয়ে তিনিই পেয়েছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।