যারা বলেন, বাবা-মার সাথে একটু ঝগড়া হইলেই মইরা যাওয়া লাগে?…তিন বছর ধরে সুইসাইডাল চিন্তায় ভুইগা আমার এতদিনে সাহস হইসে।…আপনার মনে হয় আমার খুব ইচ্ছা ছিল মরার? বাধ্য হইসি। আপনাদের তৈরি সমাজ আর পেরেন্টিংয়ের কারণে..।’
এটি ময়মনসিংহের সরকারি বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্ক প্রিয়া ধর শ্রীজার ফেসবুক আইডিতে দেওয়া ১৩ মার্চের স্ট্যাটাস। ওইদিন বেলা ২টার দিকে নগরীর স্বদেশী বাজারের রাইট পয়েন্ট নামক বহুতল ভবন এলাকা থেকে ওই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শ্রীজা ধর ময়মনসিংহ কমার্স কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক স্বপন ধর ও মুক্তাগাছা উপজেলার স্কুল শিক্ষিকা অর্পণা দের মেয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে সুইসাইড নোট লিখে বা লাইভে এসে আত্মহত্যা করার বাড়ন্ত প্রবণতা চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে অনেককে।
দেশে বর্তমানে হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা তিনগুণ, কখনও চারগুণ বেশি। দুই দশক আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে অনুপাতে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতো, তা এখন কমেছে। তবে বেড়েছে আত্মহত্যা। মানুষ এখন অন্যের ওপর যতটা না আক্রমণাত্মক হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি নিজেই নিজেকে হত্যা করছে।
সোমবার (২৮ মার্চ) দুপুর সাড়ে বারোটায় একজন নারী কলার ঢাকার হাতিরঝিলের মধুবাগ থেকে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে জানান, তার ভাই আত্মহত্যা করার জন্য তার রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা খোলেনি। তারাও চেষ্টা করে দরজা খুলতে পারেননি। এরপর হাতিরঝিল থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দরজা ভেঙে ২৫ বছরের ওই তরুণকে উদ্ধার করে। সে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বিশ্বব্যাপীই এমন ঘটনা বাড়ছে। এখন মানুষ অন্যের হাতে যতটা না খুন হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি নিজেকে নিজে খুন করছে। এর প্রধান কারণ, মানুষ তার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখছে না। হত্যাকারী ও আত্মহত্যাকারী দুজনই অসুস্থতায় ভোগে।’
হত্যার তুলনায় আত্মহত্যা তিনগুণ
রাজধানীতে ২০২০ সালে ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৬১৭টি। শিশু থেকে বয়স্ক, শ্রমজীবী থেকে উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত-কমশিক্ষিত, সব ধরনের মানুষই আছে এ তালিকায়।
২০২১ সালে ঢাকা মহানগরীতে ১৬৬ জন খুন হন। একই বছর আত্মহত্যা করে ৬৯৫ জন। যা খুনের তুলনায় চারগুণেরও বেশি।
সামাজিক ইস্যুই দায়ী
গবেষকরা বলছেন, হত্যা ও আত্মহত্যা; দুটোর পেছনেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। কেউ নিজের ইচ্ছায় হত্যাকারী বা আত্মহত্যাকারী হয় না। সামাজিক নানা কারণে হয়ে থাকে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘একটি মানুষের মানসিক গঠনে যেসব বিষয়গুলো ভূমিকা রাখে সেগুলোর কোনও একটি বিষয় যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে তার প্রভাব তার কার্যক্রমে দেখা যায়। একজন হত্যাকারীর ভেতর দেখা যাবে মানবিক অনেক কিছু অনুপস্থিত। তার গঠন ঠিকমতো হয়নি। সে অন্যের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তার মূল্যবোধের জায়গাটিও তৈরি হয়নি। সঠিক শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে একজন মানুষ হত্যাকারী হয়ে ওঠেন। আবার যিনি আত্মহত্যা করেন তার পেছনেও অনেকগুলো কারণ আছে। মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা উভয়ের জন্যই জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের যেসব এলাকা বা স্থানের মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে পিছিয়ে রয়েছে সেখানকার মানুষের মধ্যে তুলনামূলক হত্যা, যৌতুকসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সোশাল ইস্যুগুলো মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার নেপথ্যে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে এক গবেষণায় আমরা দেখেছিলাম পারিবারিক ও সামাজিক কারণেই বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বোধ যাতে বৃদ্ধি পায় এমন শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ ও অপরাধী দুটোই কমবে।’