টানা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় আর্থিক সংকটে পড়েছে তারা। ফলে মাঠের রাজনীতিতে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের আর্থিক সহায়তা দিতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
আর্থিক সংকটে পড়ার কারণ হিসেবে বিএনপির নেতৃবৃন্দ বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের দলত্যাগ, নির্বাচন বর্জনের কারণে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হওয়া, করোনাসহ সরকারের দমন-পীড়নের কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যবসায় মন্দাভাব এবং নিয়মিত চাঁদা আদায় না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ফলে দলটির আর্থিক সংকট দিন দিন বাড়ছে।
২০২০ ও ২০১৯ সালে বিএনপির আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। ২০২০ সালে বিএনপির আয় হয়েছে এক কোটি ২২ লাখ ৫৩ হাজার ১৪৯ টাকা। ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেশি হয়েছে ৫১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪ টাকা
বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দৃশ্যমান আয়ের অর্থ আসে মনোনয়ন ফরম বিক্রি থেকে। এছাড়া এককালীন অনুদান এবং দলীয় সদস্যদের মাসিক চাঁদা থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ আসে।বিএনপির ক্ষেত্রেও আয়ের উৎস একই।
ওই তিন খাতে বিএনপির আয় কমেছে— উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচনে কারচুপি এবং হামলা-মামলার কারণে বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। সর্বশেষ গত বছর থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সব ধরনের নির্বাচন থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে তারা। ফলে মনোনয়নপত্র বিক্রি থেকে যে অর্থ আসত, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দলের ব্যবসায়ী নেতারা সাধারণত এককালীন মোটা অঙ্কের অনুদান দিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির ব্যবসায়ী নেতাদের ব্যাংকঋণ পাওয়াসহ ব্যবসায়িক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। ফলে তারা আগের মতো অর্থদিয়ে দলকে সহায়তা করতে পারছেন না।
তৃতীয় কারণ হিসেবে বিএনপি নেতাদের মন্তব্য, দলীয় সদস্যদের মাসিক চাঁদা আগের মতো জমা পড়ছে না। ফলে দিন দিন দলটির আর্থিক সংকট বাড়ছে। এদিকে, আর্থিক সংকট বাড়লেও ব্যয় কিন্তু কমছে না, বরং বাড়ছে।
তবে, বিএনপির আর্থিক সংকটে পড়ার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কোনো কথা বলছেন না।
প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া বিএনপির সর্বশেষ গত দুই বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করলে দলটির আর্থিক সংকটের সার্বিক একটি চিত্র পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, বছরের পর বছর বিএনপির আয় কমছে। ২০২০ ও ২০১৯ সালে বিএনপির আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। ২০২০ সালে বিএনপির আয় হয়েছে এক কোটি ২২ লাখ ৫৩ হাজার ১৪৯ টাকা। ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেশি হয়েছে ৫১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪ টাকা।
২০১৯ সালে বিএনপির আয় ছিল ৮৭ লাখ ৫২ হাজার ৭১০ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয় দুই কোটি ৬৬ লাখ ৮৬ হাজার ১৩৭ টাকা। ওই বছর দলটির আয়ের প্রায় তিন গুণ বেশি অর্থ ব্যয় হয়।
আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
একই প্রশ্ন রাখা হয় বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ শ্যামলের কাছে। তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান। বলেন, ‘আসলে দলের অর্থনৈতিক বিষয়টি দেখভালের এখতিয়ার আমার নেই। বিষয়টি দলের মহাসচিব ও দপ্তর সম্পাদক দেখভাল করেন।’
তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে দলীয় তহবিলে টাকা দেওয়ার লোকের অভাব হয় না। শুধু দলীয় তহবিলে নয়, অনেকে তখন ব্যক্তিগত উপহারও দেন। কারণ, তারা দলীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটান। কেউ তদবিরও করেন। কেউ কেউ আবার দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নানা সুবিধা আদায় করে নেন। কিন্তু দল ক্ষমতায় না থাকায় এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সবাই। টান পড়েছে দলীয় তহবিলেও।
রাজনৈতিক দলগুলোর বৈধ আয়ের বড় উৎস হচ্ছে মনোনয়নপত্র বিক্রি— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ সুবিধা আদায় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বিএনপি। কারণ ব্যাখ্যা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য বলেন, ‘দল ক্ষমতায় থাকলে যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর অভাব হয় না। তখন একটি পদের বিপরীতে অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে, দল ক্ষমতায় না থাকলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর সংখ্যাও কমে যায়। মনোনয়ন বাণিজ্যও হ্রাস পায়।’
‘এছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। ফলে মনোনয়নপত্র বিক্রি থেকে যে অর্থ আয় হতো সেটিও বন্ধ আছে। দলটির আর্থিক সংকটে পড়ার অন্যতম কারণও এটি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অনেক নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন দলীয় তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। সেই অর্থের পরিমাণ এক থেকে দুই লাখ টাকা বা তারও অধিক হতো। কিন্তু এখন আর্থিক সংকটে পড়ায় সহায়তার পরিমাণ অনেক কমেছে।
‘আর্থিকভাবে সচ্ছল অনেক নেতা এখন দলীয় তহবিলে আগের মতো অনুদান দিতে পারেন না। ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজারও মামলা দায়ের হয়েছে। ভুক্তভোগী এসব নেতাকর্মীর জামিন এবং আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। আগে দলীয় তহবিল থেকে এক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া হলেও এখন ব্যক্তিগতভাবে খরচ করতে হচ্ছে। অনেকে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করে এ ব্যয় বহন করছেন।’
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপে পড়ে দল থেকে অনেক ব্যবসায়ী নেতা পদত্যাগ করেছেন। ব্যাংক ঋণ আটকে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। ফলে অনেকে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। শুধু পদত্যাগই নয়, অনেকে আবার আওয়ামীপন্থী হিসেবে নিজেদের পরিচিত করিয়েছেন। দু-তিনজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য ও মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, খুলনা- ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী আলী আসগার লবী, জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক আলী ফালু, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত এম এ হাশেম, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ব্যবসায়ী শাহ আলম, কেন্দ্রীয় সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বগুড়ার আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানা।
অনেকে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। শুধু পদত্যাগই নয়, অনেকে আবার আওয়ামীপন্থী হিসেবে নিজেদের পরিচিত করিয়েছেন। দু-তিনজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য ও মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলে নেওয়া হয়েছে, হামলা চালানো হয়েছে। এটা এখনও অব্যাহত আছে।’ তবে, ব্যবসায়ী নেতাদের দল থেকে পদত্যাগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মোশাররফ হোসেন।
তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী এক নেতা বলেন, এসব নেতার পদত্যাগের পেছনে কয়েকটি কারণ পেয়েছি আমরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক হয়রানি, কারও কারও পাসপোর্ট আটকে দেওয়া; অনেককে ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত করা। এছাড়া কর-ভ্যাটসহ নানা ঝামেলায় ফেলাসহ ভবিষ্যতে আরও হয়রানির শিকার হতে পারেন— এমন আশঙ্কায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। দু-একজন সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ায় দল ছেড়েছেন।
‘আর আমরা যারা আছি, তারা দলের অবদান অস্বীকার করতে না পেরে এবং ভবিষ্যতে সুদিন আসবে— এমন আশায় এখনও আছি।’ ‘যেহেতু অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী দল ছেড়েছেন এবং তাদের কাছ থেকে আর আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না; সেহেতু দলের আর্থিক সংকটও দিন দিন বাড়ছে’— বলেন ওই ব্যবসায়ী নেতা।
দলের তহবিলে টানাপোড়েনের বিষয়টিও স্বীকার করেছেন কয়েকজন ছাত্রনেতা। ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্রদলে ছিলাম তখন কোনো কর্মসূচি পালনে ১০ লাখ টাকা খরচ হলে দলীয় তহবিল থেকে দুই-আড়াই লাখ টাকা দেওয়া হতো। বাকি টাকা ব্যবসায়ী নেতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পেতাম। এছাড়া ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবে তারা আমাদের উপহার হিসেবে কিছু টাকা দিতেন। এখনও দেন। কিন্তু আগে যেখানে এক লাখ টাকা চাইলে ৫০ হাজার পাওয়া যেত, এখন তারা ১০-২০ হাজার টাকা দিয়ে দায় সারছেন।’