ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে নিত্যপণ্যের দামে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশের প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষ। প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে কোনো না কোনো নিত্যপণ্যের দাম। লাগামহীনভাবে বাড়ছে চাল, ডাল ও ভোজ্যতেলের দাম। বেসরকারি ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিতে সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে পানি, গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি খরচ।
বাজারে ঢুকে পণ্যের দাম শুনতেই ক্রেতার হাত ওঠে মাথায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বাজার তদারকিতে মাঠে অভিযান চালাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু সরকারের এসব উদ্যোগও যেন বিফলে যাচ্ছে।
সরকারের নির্দেশ অমান্য করার সাহস আছে কারো? অথচ সরকারের নির্ধারিত দাম ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আইন প্রয়োগে নিয়োজিতরা দিব্যি নির্বিকার। এর থেকে হতাশার আর কী হতে পারে।
বলতে গেলে, পুরো দেশই ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। সংকটকালীন সময়ে নিত্যপণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। দীর্ঘমেয়াদি হিসাবে আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদনে বেশি মনোযোগী হওয়ার কথাও বলেছেন। এছাড়াও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত বাজার তদারকি করা, বাজার সংক্রান্ত নীতিতে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত, এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর পরামর্শ দেন।
সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই ব্যবসায়ীরা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন। সরকার নির্ধারিত দাম উপেক্ষা করে কীভাবে ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করে, তা বুঝে উঠতে সক্ষম নন অনেকে।
পর্যাপ্ত মজুত, আমদানি থাকলেও সরবরাহ লাইনে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কিংবা নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে চাল, চিনি, মসুর ডাল, প্যাকেট আটা, ভোজ্যতেল সয়াবিন, পাম অয়েল, আটা-ময়দার দাম। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে টানা ছয় মাস ধরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।
আবার এখন যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের অজুহাত। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের যে বিশাল পার্থক্য, সেটাও আমাদের বড় সমস্যা। আমদানি ও খুচরা পর্যায়ের পণ্যমূল্যের পার্থক্যটাও একইভাবে অনেক বেশি। কিছুদিন আগেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে ১৩ টাকার সবজি রাজধানীর খুচরা বাজারে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়।
পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন নজির নেই। সুতরাং নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের মূল্য সমন্বয় করতে হবে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ইস্যুতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে এখনই দেশের বাজারে তার প্রভাব সেভাবে পড়ার কথা নয়। অথচ তিন থেকে ছয় মাস আগে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া এই ইস্যুর আগেও সব জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল।
এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য মূল্যের অস্থিরতা সামলাতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। ১ কোটি পরিবারকে ফ্ল্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু করেছেন। ভোজ্যতেলসহ চিনি ও ছোলার ওপর থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রত্যাহার করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিতে আমদানিতে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
নিত্যপণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) মার্জিনের হার ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে সারাদেশে বাজারে তদারকি জোরদার করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পণ্য বেচাকেনায় পাকা রসিদের ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন।
রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নিত্যপণ্যের সরবরাহ লাইন স্বাভাবিক রাখা এবং ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে বাজার তদারকির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে যাতে স্থানীয় বাজার অস্থিতিশীল না হয়ে ওঠে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে বাণিজ্য সচিবকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। এ টাস্কফোর্স নিত্যপণ্যের চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক বাজারদর ও আমদানি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বা সরবরাহ লাইনে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের বাজারের দায়িত্ব পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সরকারের এ ব্যবসায়ী তোষণনীতির কারণে ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট হলেও সাধারণ মানুষের মুখে হাসি নেই।
সরকারের বাজার সামলানোর পরিকল্পনায় আছে, আমদানি পণ্য দ্রুত ছাড় দিতে বন্দর ও কাস্টমসকে নির্দেশনা, পণ্যবাহী ট্রাক চাঁদাবাজমুক্ত রাখতে সক্রিয় থাকবে হাইওয়ে পুলিশ এবং পণ্য পারাপারে অগ্রাধিকার দেবে বিআইডব্লিউটিএ, আন্তর্জাতিক বাজারদর মনিটরিং করে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেবে বাণিজ্য সচিবের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স, বাজার মনিটরিংয়ে ডিসি-ইউএনওরা সক্রিয় থাকবেন এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুদদারির বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নজরদারি বাড়াবে।
নিত্যণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ হলো, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালনের চেয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষাবলম্বন করেন। প্রতি বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রমজান, ঈদ ও কোরবানির সময় নিত্যপণ্যের মজুদ, দর, সরবরাহ ও আমদানি নিয়ে সভা করেন।
বাণিজ্য মন্ত্রীর সভাপতিত্বে এসব সভায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন, পাইকারি বাজারসমিতি, খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিনিধি, আমদানিকারক, মিলমালিক, রিফাইনারিসহ অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু ভোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর প্রতিনিধিকে সভায় সেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে গঠিত টাস্কফোর্সেও ভোক্তা প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নির্ধারিত দাম কার্যকরে সরকারের নিবিড় নজরদারি ও তদারকির অভাবে কখনোই বাজার দর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তৃণমূলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব, জনবল স্বল্পতা এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের হীন প্রচেষ্টা অনেকাংশে দায়ী। এছাড়াও নীতিনির্ধারকদের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের অবদানও কম নয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি সংস্থার বাজার মনিটরিং টিম কাজ করলেও তাতে সুফল আসে না। কারণ এসমস্ত মনিটরিং টিমগুলো বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করে বাজারে যান। আবার বাজারে প্রবেশের আগে বাজার সমিতি ও চেম্বারগুলোকে অবহিত করে যান। ফলে বাজার সমিতি ব্যবসায়ীদের আগে ভাগেই সর্তক করে দেন। ফলে মনিটরিং টিম বাজারে তেমন কোনোত্রুটি পান না।
মুনাফা অর্জনের নামে তিন থেকে চারগুণ পর্যন্ত অতিমুনাফা অর্জনের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
আবার স্বল্প সময়ে বাজারে অবস্থান করলে, অনিয়ম বের করা কঠিন। সেকারণে এসব টিম বাজার মনিটরিং করে ফিরে যাওয়ার পরই বাজার আগের অবস্থানে চলে যান। বাজার মনিটরিং হওয়া উচিত পুরো বছর জুড়ে। বাজার মনিটরিং এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে বাজার সমিতি, চেম্বার প্রতিনিধি রাখা হলেও ভোক্তা হিসেবে ক্যাব প্রতিনিধি রাখা হয় না। সেকারণে ঢাকা শহরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি টিম বাজার তদারকি করার কথা থাকলেও বাজারে ভোক্তারা এই টিমের দেখা পান না। ফলে বাজার মনিটরিং অনেকটাই একপেশে এবং ভোক্তাদের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যায়। আমদানিকারক, উৎপাদক, পরিবেশক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে সমন্বিত বাজার (ভোক্তা ও গণমাধ্যম প্রতিনিধি সমন্বয়ে) তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের বাজারের দায়িত্ব পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সরকারের এ ব্যবসায়ী তোষণনীতির কারণে ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট হলেও সাধারণ মানুষের মুখে হাসি নেই। কোভিডকালে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যে কমেছে, তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। গত কয়েক বছরে সরকারের পদক্ষেপ সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি কেন থামানো যায়নি, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
উদার বাণিজ্য নীতির সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান বাজারের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করার অপচেষ্টা করছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে মুনাফা করতেই হবে। কিন্তু মুনাফা অর্জনের নামে তিন থেকে চারগুণ পর্যন্ত অতিমুনাফা অর্জনের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ও সেলফ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সম্প্রতি কারসাজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ভোজ্যতেলের বাজার থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে তিনি এ অপকর্মের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন কঠোর হুঁশিয়ারি। শুধু সাবধান বাণী উচ্চারণ যথেষ্ট নয়; চিহ্নিতপূর্বক দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমুলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
এছাড়াও আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষসহ মধ্যম আয়ের মানুষের কাছে ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশেও প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ন্যায্য মূল্যের দোকানই অন্যতম বিকল্প হতে পারে। ন্যায্য মূল্যের দোকানের মডেল বর্তমান নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য থামানো ও দুর্বিষহ দুরবস্থা থেকে জাতিকে রেহাই দিতে পারে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব