বগুড়া থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ১৫ টন সবজি নিয়ে আসা একটি ট্রাকের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। ২৪০ কিলোমিটার এই পথে অন্তত আরো ১০টি স্থানে এক হাজার ৫০ টাকা দিতে হয় চাঁদা।
বগুড়ায় একজন কৃষক ২০ টাকা কেজিতে যে কাঁচা মরিচ বিক্রি করছেন, রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে একজন ক্রেতাকে সেই কাঁচা মরিচ কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। একইভাবে ২৫ টাকা কেজিতে বগুড়ায় যে বেগুন বিক্রি হচ্ছে রাজধানীতে তা কিনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। ৩০ টাকার শসা কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়।
সড়কে চাঁদাবাজির কারণে কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছতে একই সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে তিন থেকে চার গুণ। পথে পথে চাঁদা দিতে না হলে রাজধানীতে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৩০ টাকা, বেগুন ৩৫ টাকা, শসা ৪০ টাকায় কেনা সম্ভব হতো।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা। কারওয়ান বাজারে সবেমাত্র একটি সবজিবোঝাই ট্রাক এসে থামল। স্টার্ট বন্ধ করে চালক শহীদুল হক নিচে নেমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। ‘চাঁদা দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছি। এক ট্রাক মাল এনে লাভ কত? সবজি ব্যবসায়ীরা ট্রাকভাড়া দেবেন না চাঁদার টাকা দেবেন?’
চালক শহীদুলের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পথের মোড়ে মোড়ে চলছে চাঁদাবাজি। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের কথা বলে বিভিন্ন হারে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। চাঁদা না দিলে দুর্বৃত্তরা গাড়ি ভাঙচুর করে। বিশেষ করে গাড়ির সামনের হেডলাইট বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে দেয়। বাধা দিলে গায়ে হাত তোলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পথে পথে চাঁদাবাজি, বারবার হাতবদল, অতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাত এবং বাজারে যথাযথ নজরদারি না থাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে সবজির দাম। গ্রামের কৃষকের হাত থেকে সবজি রাজধানীতে ভোক্তার হাতে পৌঁছতে অন্তত চারবার হাতবদল হয়। কৃষক থেকে পাইকার, সেখান থেকে রাজধানীর আড়ত, সেখান থেকে ছোট পাইকার, তার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতা। এরপর ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছতে প্রতিটি পর্যায়ে দাম বাড়ছে একটি সবজির।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনার পর টনক নড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয় পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি বন্ধের।
বগুড়ার মহাস্থানগড় হাটে কথা হয় ট্রাকচালক শাহিন সরকারের সঙ্গে। সপ্তাহে তিন দিন তিনি বগুড়া থেকে সবজিবোঝাই ট্রাক নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে যান। পথে পথে চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে একটি চিত্র তুলে ধরেন তিনি। চিত্রটি এমন—মহাস্থানগড় থেকে রওনা হয়ে সবজিবোঝাই ট্রাক বগুড়া পৌরসভার ভেতর দিয়ে যেতে ৫০ টাকা, শেরপুরে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতির ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতির ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে যেতে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ মোড়ে হাইওয়ে পুলিশকে ১০০ টাকা, যমুনা সেতু গোলচত্বর হাইওয়ে পুলিশকে ১০০ টাকা, টাঙ্গাইল মোড় হাইওয়ে পুলিশকে ১০০ টাকা, সাভারের আমিনবাজারে লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রতি ট্রিপে ১০০ টাকা, গাবতলীতে ২০০ টাকা, ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নামে ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এভাবে প্রতি ট্রিপে ১,০৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
এভাবে প্রতি ট্রিপে ১,০৫০ টাকা চাঁদার সঙ্গে যমুনা সেতুর টোল এক হাজার টাকা। এ ছাড়া জেলা পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত আসতে প্রতিটি সবজিবাহী ট্রাককে মাসে দুই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে। পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এই তথ্য রয়েছে। এসব খরচই যুক্ত হয় পরিবহন খরচ হিসেবে। এর পরই নির্ধারণ করা হয় একটি সবজির দাম।
মহাস্থানগড় বাজারে কথা হয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, ঝামেলাহীন ব্যবসা করতে পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের (কথিত শ্রমিক) প্রতিনিধিকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। সেই খরচও যুক্ত হয় সবজির দামে।
গতকাল শনিবার মহাস্থানগড় হাটে প্রতিমণ মুলা বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা, বেগুন ১,১০০ থেকে ১,৩০০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকা, পটোল ১,৪০০ থেকে ১,৬০০ টাকা, করলা ১,৬০০ থেকে ১,৮০০ টাকা, শসা ১,২০০ থেকে ১,৩০০ টাকা, পেঁয়াজ ৯০০ থেকে ১,৩০০ টাকা, ক্ষীরা ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকা, আলু প্রকার ভেদে ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা, টমেটো ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা। লাউ প্রতি শ ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
স্থানীয় আড়তে সবজি পরিষ্কার করে প্রতি বস্তায় ভরতে শ্রমিক ৪০ টাকা (কেজিপ্রতি ৬৬ পয়সা), প্রতি বস্তা ট্রাকে তুলতে শ্রমিক ৪০ টাকা (কেজিপ্রতি ৬৬ পয়সা), রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছাতে গড়ে প্রতি কেজি সবজির ট্রাকভাড়া এক টাকা, রাজধানীতে প্রতি বস্তা ট্রাক থেকে নামানো ও ভ্যানে আড়তে পৌঁছানো ৪০ টাকা (কেজিপ্রতি ৬৬ পয়সা), এরপর আড়তদারি বাবদ কেজিপ্রতি দিতে হয় এক টাকা।
স্থানীয় পরিবহন, শ্রমিক, বস্তা-সুতলি, ঢাকায় পৌঁছানো, আড়তদারি ও চাঁদাবাজি মিলিয়ে একটি সবজি রাজধানীতে পৌঁছাতে প্রতি কেজিতে ছয়-সাত টাকা খরচ পড়ে। এরপর আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে তা যায় খুচরা বিক্রেতার কাছে।
আমির হোসেন নামের এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি মহাস্থানগড় হাটে কৃষকের কাছ থেকে শসা কিনি ২৯ টাকা কেজি। কয়েক হাত ঘুরে খুচরা বিক্রেতারা তা বিক্রি করেন ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। ’ একইভাবে মহাস্থানগড় হাটে কৃষকের কাছ থেকে ২০ টাকা দরে কাঁচা মরিচ কেনেন পাইকারি ব্যবসায়ী সমির হাওলাদার। খুচরা বিক্রেতারা রাজধানীতে সেই মরিচ বিক্রি করেন ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি।
পরিবহন খাতসংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলছেন
মহাস্থানগড় হাট থেকে রাজধানীতে আসা (১৫ টন সবজি) একটি ট্রাকে তেল খরচ, পথের খরচ, কর্মচারীদের বেতন মিলিয়ে মোট খরচ হয় প্রায় ৯ হাজার টাকা। ২৪০ কিলোমিটার এই দূরত্বে ভাড়া নেওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রতি কিলোমিটারে পরিবহন খরচ বেড়েছে ছয় টাকা। কিন্তু তাঁরা বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন ১৯ টাকা ৮০ পয়সা। ডিজেলের দাম বাড়ার আগে এই রুটে প্রতি কেজি সবজি পরিবহনে খরচ পড়ত গড়ে ৬০ ৭০ পয়সা। এখন তা বেড়ে এক টাকা ১০ পয়সা।
মহাস্থানহাটে সবজি কিনতে আসা রাজধানীর পাইকার আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘সবজির দাম বাড়ার আরেকটি বড় কারণ, খুচরা বিক্রেতারা পিকআপ কারওয়ান বাজার স্ট্যান্ডে রাখতে বছরে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দেন। আর প্রতি ট্রিপে ১০ শতাংশ এবং মাসে ৫০০ টাকা দিতে হয় স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে। এসব কারণে বেড়ে যাচ্ছে সবজির দাম।
সবজির বাজার নিয়ে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজধানী পর্যন্ত সবজি পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এতে পণ্যের দাম দুই থেকে তিন গুণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এই চাঁদাবাজি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই প্র্রতিবেদনে চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে সবজির বাজার চড়া হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চাঁদাবাজি রোধে মাঠ পর্যায়ে পুলিশকে নির্দেশনা : পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, পথে পথে চাঁদাবাজি রোধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া মহাসড়ক অথবা সড়কে চলাচলকারী পণ্যবাহী কোনো ট্রাক থামানো যাবে না।
অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এম খুরশীদ হোসেনের সভাপতিত্বে পুলিশ সদর দপ্তরে গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনাসংক্রান্ত এক ভার্চুয়াল সভায় মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চাঁদাবাজি রোধের বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানো হয়েছে। আর পুলিশ সদর দপ্তর গত মঙ্গলবার চাঁদাবাজি বন্ধে সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সড়কে পণ্যবাহী পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের যারা অপরাধ করে তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে। পণ্যবাহী পরিবহন থেকে পুলিশের কোনো অসাধু সদস্য অর্থ আদায় করে কি না সেটাও নজরদারি করা হচ্ছে।
হাইওয়ে থানার ওসি প্রত্যাহার
এদিকে সড়ক-মহাসড়কে সবজিবাহী পরিবহনে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে যখন নানা বিতর্ক চলছে, তখন ফরিদপুরের ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ওসি এ এস এম আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ায় তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার হামিদুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গত বৃহস্পতিবার এ এস এম আসাদুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনের অয়োজন করেন। ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ওসির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘হাইওয়ে থানা পুলিশ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি মহাসড়কে চাঁদাবাজি করলে তার দায়দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশ নেবে না। ’