তিন পার্বত্য জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীতে এবার পাহাড়ে ৩ হাজার সদস্য নিয়ে শসস্ত্র সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। আগামী বর্ষা মৌসুমে এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ের বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং এই ৬টি সম্প্রদায়কে অনগ্রসর ও শান্ত স্বভাবের সম্প্রদায় হিসাবে গণ্য করা হলেও এবার তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। ৪৭-এর উপ-মহাদেশের বিভক্তি ও ৭১ পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে পার্বত্য জেলা ছেড়ে ভারতের মিজোরাম, লংত্লাই, লুংলেই ও মামিট জেলায় দেশান্তরি হয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এই সম্প্রদায়ের অনেকে। তাদের অনেকে এখন আর্থিক সহায়তা ও সক্রিয় অংশগ্রহনের মাধ্যমে এই কুকি-চিন রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য শসস্ত্র আন্দোলনে নামছে।
আরো জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-খন্ড নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ নামে একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে (কেএনএফ) এবং এর শসস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) মনে করে, পাহাড়ের ৯টি উপজেলা তাদের পূর্ব-পুরুষদের আদিম নিবাস, ব্রিটিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দখলদাররা অনুপ্রবেশ করে এবং এই ভূমি দখল করে নেয়, ফলে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
কেএনএফ-এর অভিযোগ, বিভিন্ন মহল তাদের ভূমিতে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। জেএসএস’সহ অন্য সংগঠন গুলো কুকি-চিন জনগোষ্ঠীদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম সহ নিরীহ মানুষদের ভীতির মধ্যে রেখেছে।
বম সোস্যাল কাউন্সিল-বাংলাদেশ (বিএসসিবি) সভাপতি লালদুহ সাং বম বলেন, কেএনএফ এর ফলে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িকসহ বিভিন্ন সংঘাত বেড়ে যাবে, যা উদ্বেগের বিষয়।
কেএনএফ-এর দাবী মতে, রাঙামাটির সাজেক উপত্যকা বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবান উপকন্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো অঞ্চল হয়ে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানছি, লামা ও আলীকদম মোট ৯টি উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক রাজ্য সৃষ্টি করা।
সংগঠনটি ২০১৭ সালে কেএনভি নামে সশস্ত্র সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তীতে মনিপুর রাজ্যের এবং বার্মার কারেন বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে, একই বছরে সংগঠনটির কয়েক শ সদস্যকে মনিপুর রাজ্যে ও পরে শতাধিক সক্রিয় সদস্য কাচিন, কারেন প্রদেশ এবং মনিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠায়। ২০১৯ সালে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে শসস্ত্র অবস্থায় পার্বত্য জেলায় ফিরে আসে। দেশের রুমা সীমান্ত ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে একে ৪৭সহ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এ সংগঠনের শসস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে মোট ৩ হাজারের বেশি সদস্য আছে। খৃষ্টানদের উপর সংখ্যাগুরুদের ধর্মীয় আগ্রাসন ও বিমাতাসূলভ আচরণের জন্যই মূলত এ কেএনএফ সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসন দাবী করছে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আকতার বলেন,এই ধরণের সংগঠনের কোন কার্যক্রম আমরা এখনো পায়নি, যদি কোন অপরাধ মূলক কাজ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
দূর্গম এলাকার ক্যাম্পে কেএনএফ এর মহিলা সদস্যরা। ছবি-সংগ্রহ।
আরো জানা গেছে, গত ২৪ মার্চ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মিজোরাম রাজ্যের লংতলাই জেলার পারভা থেকে অবৈধ সরঞ্জামসহ এই সংগঠনের ৬ সদস্যকে আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। আটকৃতরা হলো, রামডিন্ডলিয়ান (২০), সাংখুং বম (৩২), লিয়ান বাভিসাং (২৫), লালসাংরেম বম (৩৪), লালরাম মাউই (৪৫), নুনসাং বাওম (৩৯)। তারা বান্দরবানের রুমার বাসিন্দা বলে বিএএসফের কাছে পরিচয় দেয় এবং গত ১২ এপ্রিল পারভা ১১৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ কর্তৃক সশস্ত্র সরঞ্জাম সহ ৪ জনকে আটক করা হয়। চার জনের মধ্যে ২ জন রুমা বাজার ঘেষা এডেন ও লাইরুনপি পাড়ার বাসিন্দা।
কেএনএফ এর শসস্ত্র তৎপরতা সম্পর্কে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, এই সংগঠনের শসস্ত্র কর্মকান্ডের বিষয়টি আমাদের জানা নেই, আমরা খতিয়ে দেখছি।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে সরকার পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করলেও পাহাড়ে শান্তি ফিরেনি। পার্বত্য জেলায় জেএসএস (মূল), ইউপিডিএফ (মূল), জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও মগ পার্টি নামে ৫টি সংগঠনের সংঘাত ও অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে অশান্ত পাহাড়, সেই সাথে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর আত্মপ্রকাশ পাহাড়ে সংঘাত আরো বাড়বে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।