সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে মাঠপর্যায়ে থাকা ৯৩ হাজার ৪১০টি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ৩০ ভাগ এই মুহূর্তে অকেজো হয়ে গেছে। আর ঝুঁকিতে রয়েছে ৬৫ হাজার। যার বেশিরভাগ হার্ডওয়্যার-সংক্রান্ত সমস্যায় রয়েছে।
অনেকগুলোর যন্ত্রাংশ হারিয়ে কিংবা চুরি হয়ে গেছে। ১৩ হাজার ২৪০টি কন্ট্রোল ইউনিটের হদিস পাচ্ছেন না ইভিএমের প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। ৭ হাজার ৩২৭টি কন্ট্রোল ইউনিট ব্যাটারির খোঁজও নেই।
মঙ্গলবার নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘ইভিএমের টেকসই ব্যবহার, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কৌশল ও সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ প্রণয়ন’ শীর্ষক দিনব্যাপী এক কর্মশালায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
কর্মশালায় জানানো হয়, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ইভিএমের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি নির্বাচনে ব্যবহারযোগ্য ইভিএমের ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
রুদ্ধদ্বার এ কর্মশালার আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় চারজন কমিশনার বক্তব্য দেন।
এতে ইসির বিভিন্ন পর্যায়ের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। কর্মশালায় অংশ নেওয়া অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা জানান, নির্বাচন কমিশন নতুন ইভিএম কেনার যে প্রকল্প নিচ্ছে, সেখানে মেশিনের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট জনবল নিয়োগ, সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউজ নির্মাণ ও পরিবহণের জন্য ডাবল ডেকার ক্যারিবয় গাড়ি কেনার পরামর্শ দেন।
তবে এ কর্মশালায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এতে অংশ নেননি। তিনি অসুস্থ থাকায় এতে অংশ নেননি বলে জানিয়েছে সিইসি’র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা।
কর্মশালায় প্রথম উপস্থাপনায় ইভিএম অকেজো সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করেন ‘নির্বাচনব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগের লক্ষ্যে ইভিএম ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান।
দ্বিতীয় উপস্থাপনা করেন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ-১-এর উপসচিব রাশেদুল ইসলাম। এতে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশনের কেনা দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ৯৩ হাজার ইভিএম মাঠ পর্যায়ে রয়েছে।
সেগুলোর মধ্যে ৪৭ হাজার ৫০০টি প্লাস্টিক হার্ডবোর্ডে ও বাকি ৪৫ হাজার ৫০০টি কাগজের বাক্সে রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে ৫৪ হাজার ৫০০টি ও নির্বাচন ভবনের বেইজমেন্টে ২ হাজার ৫০০টি ইভিএম রাখা হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যালয়ে ক্ষুদ্র পরিসরের স্টোরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ইভিএম সেট বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মজুত করা হয়েছে।
এসব মেশিন সুষ্ঠু ও মানসম্মত এবং যথাযথ নিরাপত্তার সঙ্গে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে মেশিনগুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন, এমনকি অকেজো হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
ইসি সূত্রে জানা যায়, এই দেড় লাখ ইভিএম কিনতে একনেকে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকল্প পাশ হয়। প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৫১৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়।
এছাড়া ৭৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় আসবাবপত্র ও র্যাক কেনার চুক্তিও করা হয়। তবে মেশিন সংরক্ষণ নিয়ে এমন জটিলতায় পড়েছে ইসি সচিবালয়।
এ অবস্থায় আরও দুই লাখ ইভিএম কিনতে নতুন প্রকল্প নিচ্ছে ইসি। নতুন প্রকল্প নেওয়ার সমীক্ষা হিসাবে এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান তার উপস্থাপনায় আরও উল্লেখ করেন, এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ৮৫৯টি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করেছে।
চলতি ২০২২ সালে এ মেশিনে ৪৭২টিতে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। ইভিএমে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় এটি হ্যাক করা সম্ভব না।
বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন ও ভোটার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক বিধায় ভোটকেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া সম্ভব না। তবে ইভিএমে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
সেগুলো হচ্ছে : ১. ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত এবং ২. নির্বাচনে ব্যবহার সংক্রান্ত।
ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যা তুলে ধরতে গিয়ে বেশকিছু স্থির ছবি দেখান তিনি; যেখানে অগোছাল ও অযত্নে মেশিন রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ইভিএমের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য মেশিন ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা যন্ত্রাংশ হারিয়ে গিয়েছে। ৩০ শতাংশ ইভিএম এই মুহূর্তে ব্যবহারের অনুপযোগী।
ইভিএম সংরক্ষণ সংক্রান্ত তথ্যে অসামঞ্জস্যতাও রয়েছে। ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিট ৯৩ হাজার ৪১০টি থাকার কথা থাকলেও তথ্য পাওয়া গেছে ৮০ হাজার ১৭০টির। বাকি ১৩ হাজার ২৪০টি কন্ট্রোল ইউনিটের তথ্য নেই।
ইভিএম পরিচালনায় প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট রয়েছে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সংক্রান্ত সমস্যা তুলে ধরে কর্মশালায় কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, যথাযথ কোয়ালিটি কন্ট্রোল ছাড়া ইভিএম ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এ মেশিন অপারেশন সংশ্লিষ্ট জনবলের দুর্বলতা ও ভীতি রয়েছে। মেশিনের ট্রাবলশুটারদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। দ্বিতীয় উপস্থাপনায় ইসি সচিবালয় জানায়, বিদ্যমান ইভিএম সংরক্ষণে ৩০টি জেলায় গোডাউন ও বাসা ভাড়া করা হয়েছে।
ওইসব স্থানে ইভিএম স্থানান্তর ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোয় ভাড়া করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ‘আমরা যেসব ইভিএম সংগ্রহ করেছি সেগুলোর অবস্থা জানা এবং নতুন ইভিএম কেনার বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সেখানে ইভিএম সংরক্ষণ প্রক্রিয়া কী হতে পারে, করণীয় কী, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কর্মশালায় আসা মতামত নতুন ইভিএম প্রকল্পের প্রস্তাবনায় প্রতিফলন ঘটবে।’
আরও জানা গেছে, কর্মশালার উদ্বোধনী অধিবেশনে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ইভিএম সংগ্রহ ও নির্বাচনে তা ব্যবহার করতে কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দরকার।
মিতব্যয়িতার সঙ্গে ইভিএমের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা রেখে নতুন ইভিএম কেনার প্রকল্প নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর প্রকল্প প্রস্তাবনায় বর্তমান ও প্রস্তাবিত ইভিএমের ব্যয়ের পার্থক্য তুলে ধরার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এতে প্রকল্প পাশ করা সহজ হবে।
আরেক নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, মানসম্মত ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করতে হবে। ইভিএম নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বড় আকারের সেমিনার আয়োজনের পরামর্শ দেন তিনি।
কর্মশালায় ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ইভিএম কেনার নতুন প্রকল্প একেনেকে যাতে অনুমোদন পায়, সেই ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন।