আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে। দল থেকে তাঁকে কারণ দর্শানোরও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিক রীতি অনুসারে, কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবের পর দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার কিংবা দলে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দল থেকে চূড়ান্তভাবে বাদ পড়লে পঙ্কজ নাথের সংসদ সদস্য পদের কী হবে? তিনি কি সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকবেন নাকি বাদ পড়বেন?
এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়া কঠিন। কারণ, এর পেছনে দুই ধরনের প্রক্রিয়াগত বিষয় জড়িত, আইনি বিষয় ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
রাজনৈতিক সূত্র বলছে, একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য পদে থাকবেন কি না, এটা নির্ধারণে তাঁর দল, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং নির্বাচন কমিশনের সম্পৃক্ততা দরকার। আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁর সংসদ সদস্য পদ কেড়ে নেওয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অতীতে এ ধরনের রীতি কমই আছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি পঙ্কজ নাথের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার চেষ্টা করবে? এ ক্ষেত্রে দল থেকে স্পিকারের কাছে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাতে হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে পঙ্কজ নাথকে দল থেকে অব্যাহতি দিলেও তাঁর সংসদ সদস্য পদ কেড়ে নেওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি যাতে দলের মনোনয়ন না পান, এ বিষয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের চেষ্টা আছে।
পঙ্কজ নাথ বরিশাল আওয়ামী লীগের ২৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের একজন। এই উপদেষ্টা পরিষদ কার্যনির্বাহী সংসদের অংশ নয়। অর্থাৎ তিনি যে পদ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যা গেলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বরং তাঁকে স্থায়ীভাবে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা সাংগঠনিকভাবে গুরুতর বিষয় হবে। এমনটা হলে এখন না হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন না, এটা ধরে নেওয়া যায়।
গত ১১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা অব্যাহতিপত্রে বলা হয়েছে, পঙ্কজ নাথকে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাসহ দলীয় অন্যান্য পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দিতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাধারণত সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু পঙ্কজ নাথকে সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যা অনেকটা নমনীয় পদক্ষেপ। ফলে কারণ দর্শানোর পর তাঁর পদ ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে। আর না দিলেও তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদ বহাল থাকবে। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংসদ সদস্য পদ নিয়ে সংশয় থাকবে না।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে নিজ নিজ জেলা পর্যায় থেকে কোনো নেতাকে বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করলে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সময় নেওয়া হয়। তবে পঙ্কজ নাথের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। অনেকটা ত্বরিত গতিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অতীতে সারা দেশে যেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁদের সাধারণ ক্ষমা করা যায় কি না, এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা আছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই চিন্তাভাবনা চলছে। এর মধ্যে দলের একজন সংসদ সদস্যকে ত্বরিত গতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পেছনে দলের প্রভাবশালী মহলের তদবির কাজ করেছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
সংসদ সদস্য পদ থাকা, না থাকা
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন পঙ্কজ নাথ। সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি নির্বাচনে কোনো দলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। একটি দল থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর ওই দল থেকে পদত্যাগ করলে সংবিধান অনুযায়ী তাঁর সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। পঙ্কজ নাথের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কারণ, তিনি পদত্যাগ করেননি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। কিন্তু দল কাউকে বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি দিলে সে ক্ষেত্রে কী হবে, সংবিধানে তার উল্লেখ নেই।
তবে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হইবে কি না, সে সম্পর্কে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রেরিত হইবে এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে ।’
এর বাইরে কোনো ব্যক্তি কোনো আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ও দেউলিয়া ঘোষিত হলে, বিদেশি রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করলে, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হলে, প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে থাকলেও সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।
এর আগে দশম সংসদে ২০১৪-১৫ সালে ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন এবং দলের সব পদ হারান। তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের সুপারিশ করে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। স্পিকার পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) চিঠি দেন। শেষ পর্যন্ত জটিলতার সুরাহা না হলে রাজনৈতিক চাপে নিজ থেকে পদত্যাগ করেন লতিফ সিদ্দিকী।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি থেকে নির্বাচিত আবু হেনাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিল বিএনপি। তখন আবু হেনার সংসদ সদস্য পদ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তৎকালীন স্পিকার।
পঙ্কজ নাথের ওপর যে কারণে খড়্গ
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পঙ্কজ নাথ। সে সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসা এবং নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এরপর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতেই রাখা হয়নি। পরে তারা সংগঠন থেকেও বাদ পড়েন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ হারানোর পর পঙ্কজ নাথ বরিশালের রাজনীতিতে মনোযোগ দেন। কিন্তু একপর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পরিবারের সঙ্গে কিছুটা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি হাসানাতের পছন্দের যে সব প্রার্থী স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাদের বিরোধিতায় নামেন পঙ্কজ নাথ। অনেক স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করান পঙ্কজ নাথ। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। এমনকি দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বহুবার মারামারি-সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালে পঙ্কজ নাথ সংসদ সদস্য হওয়ার পর হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে দলীয় সংঘাতে বেশ কিছু খুনের ঘটনাও ঘটে।
১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এতে সংঘাতের আশঙ্কা করে পঙ্কজ নাথকে দলের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে গত ৪ আগস্ট চিঠি দেয় বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ। এতে গত ২৮ আগস্ট মেহেন্দীগঞ্জ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
এর আগে জুলাইয়ে মেহেন্দীগঞ্জ থানার এক পরিদর্শকের সঙ্গে পঙ্কজ নাথের ফোনালাপ ফাঁস হয়। এতে পঙ্কজ নাথকে বলতে শোনা যায়, ‘যে সামনে পড়বে তাঁকেই কোপাবে। যা হইছে হইছে। ওরা মারামারি করলে কিন্তু যে সামনে পড়বে তারেই কোপাইবে। মেয়র সামনে পড়লে মেয়রকে কোপাইবে।’
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১০ সেপ্টেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বোর্ডের অন্যতম সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এর পরদিনই পঙ্কজ নাথকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পঙ্কজ নাথের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে চাননি। আর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মুঠোফোনে কল করলে তিনি ধরেননি।