কুমিল্লা জেলার মেঘনা থানার ২নং মানিকাচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেনের (৪৩) গাড়ি ব্যবসার ফাঁদে পা দিয়ে হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন এমপি-পুলিশসহ তিন শতাধিক মানুষ। প্রতারণার এই টাকা দিয়ে জাকির হোসেন নিজে কিনেছেন গাড়ি-বাড়ি-জমি, ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
২১ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লা জেলার মেঘনা থানা এলাকা তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জাকির চেয়ারম্যান মূলত কয়েক ধাপে প্রতারণা করেছেন। অন্য কেউ গাড়ি কিনে মাসিক চুক্তিতে তাকে দিত রেন্ট-এ-কার ব্যবসার জন্য। জাকির সেই গাড়ি বিক্রি করে দিতেন, যিনি গাড়ি দিয়েছিলেন তাকে মাসিক চুক্তির টাকাও দিতেন না। আবার স্বল্প মূল্যে গাড়ির মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়েও হাতিয়ে নিতেন টাকা।
ঢাকায় বাস চালকের সহকারি, গাড়িচালক থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যাওয়া জাকিরের প্রতারণার শিকারদের একজন মুন্সিগঞ্জের মো. সায়েম। ১৫ লাখ টাকায় দোকান বিক্রি করে সেই টাকায় গাড়ি কিনে জাকিরের হাতে তুলি দিয়েছিলেন সায়েম। চুক্তি ছিল এই গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে মাসিক ৭০ হাজার টাকা দেবেন জাকির।
কিন্তু প্রথম মাসের ভাড়া দিয়ে সায়েমকে আর কোনো টাকা দেননি জাকির। শেষ পর্যন্ত নিজের গাড়িও ফেরত পাননি সায়েম।
সায়েম বলেন, এক বছর ভাড়া দেয়নি। টাকার জন্য চাপ দিলে সাড়ে সাত লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দেয় আমাকে। বাকি টাকা চাইলে মামলার হুমকি দেয়।
একই গাড়ি প্রতারক জাকির ২৫ জনের কাছে বিক্রি করেছে উল্লেখ করে সায়েম বলেন, পুলিশ প্রশাসন ও কয়েকজন সংসদ সদস্যও এই জাকির চেয়ারম্যানের ক্লায়েন্ট। তাদের দেখেই আমরা সাধারণ মানুষ আস্থার সঙ্গে রেন্ট এ কার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলাম।
পুলিশ বলছে, সাধারণ মানুষ ছাড়াও জাকির হোসেনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন সংসদ সদস্য, পুলিশ সদস্যও। অবশ্য প্রভাবশালী এই ব্যক্তিদের মাসিক চুক্তির টাকা পরিশোধ করেছেন জাকির।
সায়েমের মতো প্রতারণার শিকার মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি এলাকার সোহেল মোল্লা। মিন্টো রোডে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, পুলিশের অনেক এসআই, ওসি দেখে আমি আস্থা পাই। বেশি মুনাফার লোভে সেখানে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দুটি গাড়ি কিনি। গাড়ি কেনার পর কয়েক দফায় সাড়ে সাত লাখ টাকা আমি পেয়েছি। বাকি টাকা আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে আর দেয়নি।
প্রতারণার শিকার আরেক ব্যক্তি মাসুম মোল্লা। তিনি রাজধানীর চাঁদনি চকে থ্রি পিসের ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমার ব্যবসার টাকায় তাকে ১৫ লাখ টাকায় একটা হায়েস গাড়ি কিনে রেন্ট এ কারের ব্যবসায় চুক্তি করি মাসিক ৭০ হাজার টাকায়। এক বছরে মাত্র এক মাসের টাকা দিয়েছে। এরপর টাকাও নেই, গাড়িও নেই।
আজ (শুক্রবার) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে জাকির চেয়ারম্যানের প্রতারণার বিষয়ে কথা বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান হারুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, রেন্ট-এ-কারের ব্যবসার আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন জাকির চেয়ারম্যান। তিনি দুই তিন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, গত কয়েকদিনে ডিবি অফিসে দুই শতাধিক ভুক্তভোগী ভিড় করেছেন। আমরা তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলাম, শুধু মুন্সিগঞ্জের একটি গ্রাম থেকেই ১৫০ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক জাকির।
হারুন বলেন, তার গাড়ি রয়েছে ২০ বা ২৫টা। সেসব গাড়ি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সবাইকে দেখাতেন। তিনি কয়েকজন এমপি, প্রশাসনের লোকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন। তবে তাদের কাছে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য মাসিক কিস্তির টাকা ঠিকই মাসে মাসে পরিশোধ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে ও মুগদা থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা (তেজগাঁও) বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিম বিশেষ অভিযান চালিয়ে জাকির চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করে।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি, তিনি গ্রামের বাড়িতে প্রতারণার সেই টাকায় আলিসান বাড়ি করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে কাউকে প্রাডো গাড়ি কিনে দিয়েছেন, নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচ করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। ঢাকা শহরে তিনি গাড়ি-ফ্ল্যাট-প্লট করেছেন। প্রতারণার টাকায় তিনি নিজের ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। আগামী নভেম্বরে তারও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। আমরা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের চেষ্টা করা হবে। তার সম্পদ জব্দের জন্য প্রয়োজনে সিআইডিতে মামলা হস্তান্তর করা হবে।
এর আগেও তাকে গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন,কিন্তু অনেকে বলেছেন, তিনি গ্রেপ্তার হলে মাসিক কিস্তির টাকা পাবেন না। কিন্তু তিনি বেশিরভাগেরই মাসিক কিস্তির টাকা পরিশোধ করেননি। মূল টাকা তো নেই, গাড়িও মেরে দিয়েছেন।
ডিএমপি ডিবি প্রধান বলেন, জাকির চেয়ারম্যান পোর্ট থেকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেন। গাড়ি রেন্ট-এ-কারের মাধ্যমে মাসিক ভাড়ায় পরিচালনা করার জন্য চুক্তি করেন। একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরের গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করেন। এছাড়াও পূর্বের বিক্রয়কৃত গাড়ি স্বল্প মূল্যে মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।