বিশাল ছাড়ে পণ্য দেওয়ার কথা বলে লোভনীয় ফাঁদে ফেলে মানুষের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছে বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এই অর্থের একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে তারা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত (সিআইডি) বিভাগ এমন ১১টি প্রতিষ্ঠানের ৭৬২ কোটি ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৩৭০ টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ১১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটির বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়েছে। অন্য দুটির চার্জশিট দেওয়া হবে যে কোনো সময়ে। বাকি নয়টি প্রতিষ্ঠানের তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ৩০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ১১টির বিষয়ে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। সেগুলোর বিরুদ্ধেই পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানসহ প্রতারণায় জড়িত ই-কমার্সগুলোর প্রায় ৮০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট গেটওয়েতে বিভিন্ন ই-কমার্সের ৫৬১ কোটি টাকা আটকে দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের এ অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে প্রতারণার মোট অর্থের হিসাব মেলানো কঠিন হচ্ছে। কারণ কিছু অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা লুটপাট করেছে। বিদেশে পালিয়ে গিয়ে সেই টাকায় আলিশান জীবনযাপন করছে তাদের অনেকে। টাকার বড় অংশ পাচার হয়েছে নন-ব্যাংকিং চ্যানেল হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে বিদেশ থেকে সেই টাকা ফেরত আনাও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। টাকা ফেরত না এলে গ্রাহকদের পুরো অর্থ পরিশোধ করাও সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় ই-কমার্সের সংকট সহসাই নিরসন করা কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, টাকা একবার হাত থেকে বেরিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। কারণ টাকা ই-কমার্সের হাত থেকে বিকল্প চ্যানেলে চলে গেছে। সেটাকে আমরা পাচার বললে তা প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেই দেশে টাকা গেছে, সেখানকার কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ঘোষিত সম্পদ হিসাবে যদি টাকাটা রাখা হয় তাহলে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সের মাধ্যমে তা ফেরানোর সুযোগ থাকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে দায়ের করা মামলার রায়ে যদি টাকা আত্মসাৎ বা পাচারের তথ্য প্রমাণিত হয় তাহলে সে রায় তাদের কাছে যাবে, এরপর সেখানকার আদালতে সে দেশের সম্পদ নিয়ে মামলা করতে হবে। ওই মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে এলে সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে, তারপর সেই টাকাটা ফেরত আনার সুযোগ তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়াতেই ৫-১০ বছর লেগে যায়। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব মামলা করে চূড়ান্ত রায় নিতে পারলে দ্রুত টাকা আনা সম্ভব হতে পারে। বললেই টাকা ফেরত আনা যায় না তিনি যোগ করেন।
তিনি আরও বলেন, এই প্রক্রিয়ায় গতি আনতে হলে আমাদের লবিস্ট নিয়োগ করা উচিত। সব এজেন্সির সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে হবে। যেই দেশে টাকা গেছে সেখানকার রাষ্ট্রদূতকে এতে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে অনেক দ্রুত তথ্য এনে আদালতের রায় পাওয়া যেতে পারে। ফিলিপাইন থেকে আমাদের তৎপরতার ফলেই অর্থ ফেরানো গেছে।
সিআইডি জানায়, ১১টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকা পাচার করেছে আনন্দের বাজার লি.। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা পাচার করেছে ই-অরেঞ্জ শপ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৯৬ টাকা পাচার করেছে ধামাকা। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই ৬৬৪ কোটি ৭১ লাখ ১৪ হাজার ১৭০ টাকা পাচার করে। বাকিগুলোর পরিমাণ ১০০ কোটির নিচে। সংস্থাটির তদন্তে উঠে এসেছে, টোয়েন্টিফোর টিকেটি ডট লিমিটেড (২৪টিকেটি.লি) পাচার করেছে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩২৪ টাকা, সিরাজগঞ্জ শপ ডট কম লি. ৪ কোটি ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা, আকাশনীল ডট কম লিমিটেড ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা, রিং আইডি বিডি লি. ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, আলিফ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং লিমিটেড ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এছাড়া দালাল প্লাস ডট কম ৪১ কোটি ৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, থলায় ডট কম ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৭৩ হাজার ৮৭৬ টাকা এবং এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা পাচার করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই জেলে অথবা দেশের বাইরে আছেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, ডলার সংকটের এ সময়ে অর্থ পাচারের ঘটনাগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। সে কারণে পাচারের যতগুলো চ্যানেল আছে সবগুলোকে নজরদারির আওতায় আনছেন তারা। এ সংক্রান্ত পূর্ববর্তী অপরাধগুলোর তদন্তেও এসেছে গতি। সেসব ঘটনায় ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। এজন্য দফায় দফায় চিঠিও দিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) হুমায়ুন কবির বলেন, ই-কমার্সের অর্থ পাচারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ধামাকা ও টোয়েন্টিফোর টিকেটি ডট লিমিটেডের (২৪টিকেটি.লি) বিরুদ্ধে তদন্ত প্রায় চূড়ান্ত। যে কোনো সময় অভিযোগপত্র দেওয়া হতে পারে। বাকি নয়টি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তদন্তও গুছিয়ে আনা হয়েছে। এগুলোর কাজও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত বছরের মাঝামাঝিতে সক্রিয় হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর গ্রাহকদের পক্ষ থেকে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সারা দেশে ১০৫টি মামলা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারের আকার ১৬৬ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে এ খাতে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স খাত ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছবে বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের। কোভিড-১৯ মহামারিকালীন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে এই খাতের মোট উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ উদ্যোক্তা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সাফল্য পেয়েছেন।