হারিকেনের আবছা আলো আধারিতে বসে নানীর কাছে ছোটবেলায় গল্প শুনতাম ।আমার নানীর নানীর কারুকাজ করা গহনার বাক্সে একটি মহা মূল্যবান জিনিস ছিল । আর যেটি কিনা রাখা ছিল আরেকটি ছোট রুপার বাক্সের ভিতরে । এই প্রানভ্রমরা আর কিছু নয়, একটি মসলিন শাড়ি ।এই মসলিন কাপড় এত সূক্ষ্ম ছিল যে, একটি আংটির ভেতর দিয়ে পুরো মসলিনের শাড়িটি টেনে নিয়ে যাওয়া যেত । কেউ কেউ আবার এই শাড়ি রাখতো ছোট্ট ম্যাচবক্সে । ছোটবেলায় আমাদের কৌতূহলের কেন্দ্রে ছিল এই মসলিন শাড়ির গল্প ।
হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ মসলিন থেকেই এসেছে জামদানী শাড়ি । তবে জামদানির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, ‘জামদানি’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি জামা অর্থ কাপড় এবং দানা অর্থ বুটি, সে অর্থে জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়।
আরেকটি মতে, ফারসিতে ‘জাম’ অর্থ এক ধরনের উত্কৃষ্ট মদ এবং ‘দানি’ অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকির পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উত্পত্তি ঘটেছে।
ধারনা করা হয় মুসলমানেরাই ভারত উপমহাদেশে জামদানির প্রচলন ও বিস্তার করেন। আর মুঘল আমলে মসলিন ও জামদানি শিল্পের চরম উত্কর্ষ সাধিত হয়। সে সময় নানা রকম নকশা করা মসলিন ও জামদানি দিল্লি, লখনৌ ও মুর্শিদাবাদে চড়াদামে বিক্রি হতো। মসলিন বা জামদানিকে বিবেচনা করা হতো আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে ।
নবম শতকে আরব ভূগোলবিদ সুলাইমান তার গ্রন্থে বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানির উল্লেখ করেছেন । মরক্কোর প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৪শ শতকে লেখা তার ভ্রমণ কাহিনীতে সোনারগাঁওয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করতে গিয়ে মসলিন ও জামদানির কথা বলেছেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকেও বঙ্গ থেকে সোনারগাঁও বন্দরের মাধ্যমে মসলিন রপ্তানি হতো ইউরোপে । তবে মসলিন শব্দটির উত্পত্তি সম্ভবত ইরাকের মৌসুল শহর থেকে। আর জামদানি শব্দটি এসেছে পারস্য থেকে। বুটিদার জামা থেকে জামদানি শব্দটি পাঠান সুলতানদের আমলে বাংলায় সুপ্রচলিত ছিল।
কালের বিবর্তনে মসলিন হারিয়ে গেলেও মসলিনের উত্তরাধিকার জামদানি রয়ে গেছে তার আপন মহিমায় ।
প্রাচীনকাল থেকেই এই ধরনের কাপড় তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় বরাবর পুরাতন সোনারগাঁ অঞ্চলটিই ছিল মসলিন আর জামদানি শাড়ির মূল উত্পাদন কেন্দ্র। বর্তমানে শুধু মাত্র রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ এবং সিদ্ধিরগঞ্জে প্রায় ১৫৫টি গ্রামে তাঁতিরা নিষ্ঠার সাথে বংশানুক্রমে এই শিল্পের চর্চা করে চলেছেন । জামদানি শিল্পীদের বিশ্বাস, শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উঠে আসা বাষ্প জামদানির সুতার প্রস্তুতি ও শাড়ি বোনার জন্য খুবই জরুরি।
একটি জামদানি শাড়ি কেবল একজন তাঁতি বিভিন্ন রকম সুতা দিয়ে বুনে যাবেন তা নয়। বরং শাড়ি প্রস্তুত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়ে থাকে পুরো পারিবারের অংশগ্রহণ । হাতে সুতা কাটা থেকে শুরু করে সেই সুতায় রং দেওয়া, নাটাইয়ে সুতা পেঁচানো, তারপর সেটা মাকু করা—এই কাজ গুলো সাধারণত বাড়ির মহিলারাই করে থাকেন । তাঁতে টানায় যে সুতা বসানো হয়, সেই কাজের নাম হাজানি বা সাজানি। এটাও করে থাকে মেয়েরা । টানামাটির গর্তে যে খটাখট তাঁত চালানো হয় তাতে ওস্তাদের পাশে যে শাগরেদ সেও হয়তো নিজের ছেলে কিংবা আত্মীয় । তাই সানার টানে মাকু চালিয়ে যখন জামদানি শাড়ির নকশা ফুটতে শুরু করে, তা শেষ পর্যায়ে গিয়ে আর শাড়ি থাকে না, বরং হয়ে ওঠে এক একটি পরিবারের গল্পগাঁথা ।
জামদানি শুধুমাত্র ছয় গজের শাড়িই নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের কৃষ্টি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য । শাড়ির নকশার মাঝেই বোনা হতে থাকে তাঁতিদের জীবনের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা । নকশায় মিল থাকলেও জামদানি শাড়ি আসলে একেকটি শিল্পিত ক্যানভাস । আর জামদানি এমন একটি শিল্প, যেখানে পুঁজি হচ্ছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিল্পীর মেধা, মৌলিকতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, শ্রম আর আঙ্গুলের যাদু ।
আদিতে শুধুমাত্র সাদা এবং প্রাকৃতিক রঙের জামদানি তৈরি হলেও ভোক্তাদের চাহিদামত এখন লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি, আসমানি, মেজেন্টা, টিয়া,বেগুনি, কমলা সব রঙের জামদানি তৈরি করা হয় ।এরসাথে যোগ করা হয় সোনালি রুপালি জরির কাজ ।
জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ এর নকশা বা মোটিফে। জ্যামিতিক ডিজাইনের নকশা দেখলেই বোঝা যায় যে এটা জামদানি শাড়ি। যুগ যুগ ধরে প্রতিটি নকশার ভিন্ন ভিন্ন নাম প্রচলিত রয়েছে । পান্নাহাজার, বুটিদার, দুবলিজাল, তেরসা, ঝালর, ময়ূরপাখা, কলমিলতা, পুইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, আঙুরলতা, প্রজাপতি, শাপলাফুল, জুঁইবুটি, চন্দ্রপাড়, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল, পদ্মফুল, তেছরী, কলার ফানা, আদার ফানা, সাবুদানা, মালা, ইঞ্চি পাড়, করলা পাড়, চালতা পাড়, ইন্দুরা পাড়, কচু পাড়, বেলপাতা, কলকা, দুবলা ঢং, চন্দ্রহার, পানপাতা, বুন্দির, মুরুলি —এমনি নানা রকম নাম প্রচলিত রয়েছে ।
এসব নকশা কাগজে আঁকা থাকেনা । বরং জামদানির শিল্পীরা নকশা আঁকেন সরাসরি তাঁতে বসানো সুতোয় শাড়ির বুননে বুননে। এই নকশা তোলার পদ্ধতিটিও বেশ মজার। শিল্পীদের মুখস্থ করা কিছু বুলি রয়েছে। এসব বুলি ওস্তাদ শাগরেদকে বলতে থাকে আর শাগরেদ তা থেকেই বুঝতে পারে যে ওস্তাদ কোন নকশাটি তুলতে যাচ্ছেন।
নিজস্ব বুলিতে এই ছড়া হচ্ছে জামদানি নকশা তৈরির ফর্মুলাবিশেষ। জামদানি তাঁতিদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । শুধু রয়েছে বংশানুক্রমিক হাতে-কলমে অর্জিত জ্ঞান । জামদানি শাড়ি তৈরি প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক কর্মকাণ্ড একেবারেই বিকল। এতে নকশার পুরো কাজটি হাতে করতে হয় বলে সময় লাগে বেশি । পুরো জমিনে নকশা করা একটি মোটামুটি মানের শাড়ি তৈরি করতে ন্যূনতম সময় লাগে চার সপ্তাহ থেকে ৪ মাস।
মাঝে ভিনদেশি সস্তা শাড়ির ভিড়ে জামদানি কিছুটা আড়ালে থাকলেও ইদানীং আপন মহিমায় জামদানি ফিরে এসেছে সগৌরবে, দাপটের সাথে । আধুনিক রুচি ও আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে জামদানির বিকল্প নেই । তাইতো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জামদানির কদর এখন সারা বিশ্বে।