চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের জন্ম নিবন্ধন সার্ভার আইডি হ্যাক করে ছয়টি ওয়ার্ডে ৬৮০টি ভুয়া জন্মনিবন্ধন ইস্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ইতোমধ্যে ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় একাধিক হ্যাকার চক্র কাজ করেছে। প্রতিটি চক্রে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। তারা টাকার বিনিময়ে মানুষকে অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধন পাইয়ে দিচ্ছে। জন্ম নিবন্ধন সনদ পেয়েছে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গারাও। এর মাধ্যমে এসব রোহিঙ্গারা পেয়েছেন এনআইডি এবং বাংলাদেশি পাসপোর্ট। তবে এখন পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা এসব ভুয়া জন্মনিবন্ধন পেয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
গত ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পাওয়া গেছে। তারা হলো- মো. জহির আলম (১৬), মোস্তাকিম (২২), দেলোয়ার হোসাইন সাইমন (২৩) ও মো. আব্দুর রহমান ওরফে আরিফ (৩৫)। এর মধ্যে দেলোয়ার হোসাইন সাইমন নগরের ইপিজেড এলাকার একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক। তাদের কাছ থেকে চারটি সিপিইউ, তিনটি মনিটর, একটি স্ক্যানার, প্রিন্টার ও চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে, ২৫ জানুয়ারি রাতে এ চক্রের আরও দুজনকে গ্রেফতার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এর মধ্যে একজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় মো. রাকিব হোসেন ওরফে হিমেল (২৭) নামে এক কম্পিউটার দোকানিকে।
জানুয়ারির ১৫ দিনে চসিকের ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর, ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড ও ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে নয়বার আইডি হ্যাক করে ৬৮০টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে চক্রটি। হ্যাকারদের কবলে পড়া এই ছয়টি ওয়ার্ডে বর্তমানে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।
সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ডা. মুহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, গত ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর (বন্দর) ওয়ার্ডের সার্ভার থেকে ৪০টি, ৯ জানুয়ারি ১৩ নম্বর ওয়ার্ড (পাহাড়তলী) সার্ভার থেকে ১০টি এবং ২১ জানুয়ারি ৪০ নম্বর ওয়ার্ড (পতেঙ্গা) সার্ভার হ্যাক করে ৮৪টি জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে চক্রটি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে সাধারণ ডায়েরি করার পর আমাদের নজরে আসে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে এই চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সার্ভার হ্যাক করে এসব জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়েছে, নাকি সিটি করপোরেশনের কেউ এ কাজ করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে প্রত্যেক কাজই রেজিস্ট্রার মেনে করা হয়। আমি নিজেই তা প্রত্যক্ষ করি। যখন দেখি ১০টি জন্ম নিবন্ধন ইস্যু হয়েছে, অথচ আমার রেজিস্ট্রারে এর সিরিয়াল নেই। তখন তদন্ত করি। সিটি করপোরেশনের আইটি কর্মকর্তাকেও এ বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ১০টি জন্ম নিবন্ধন ইস্যু কোনও হ্যাকার চক্রের মাধ্যমে করা হয়েছে জেনে আমরা পাহাড়তলী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, জানুয়ারির ১৫দিনে ছয়টি ওয়ার্ডে একাধিকবার জন্ম নিবন্ধন আইডি হ্যাক হয়েছিল। এতে হ্যাকার চক্র ৬৮০টি জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে। এর মধ্যে ৮ জানুয়ারি হ্যাক করে ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে ৪০টি জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে হ্যাকাররা। একই দিন ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করেও চারটি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করে তারা। ১০ জানুয়ারি ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ১০টি জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করে, একইদিনে ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করে তারা।
একই ওয়ার্ডে ১৯ জানুয়ারি ৫০টি এবং ২২ জানুয়ারি ইস্যু করা হয় ৩৪১টি জন্ম নিবন্ধন সনদ। ২১ জানুয়ারি ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ৮৪টি জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। ২৪ জানুয়ারি ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে ৩৫টি এবং এর আগে ৯৮টি ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড অফিসের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় পৃথক অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
চসিক সূত্র জানিয়েছে, হ্যাক করে যেসব জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই জামালপুর, শরীয়তপুর, উখিয়া ও কক্সবাজার এলাকার বাসিন্দাদের জন্য। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারও কারও হাতে এসব ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ পৌঁছেছে বলে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে কতজন রোহিঙ্গা এসব ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ হাতে পেয়েছে তা এখনও নিশ্চিত নয় সংস্থাটি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ডিসি ডা. মুহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ আরও বলেন, ‘প্রথম দফায় গ্রেফতার চার জন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা সার্ভার হ্যাক করে পাঁচ হাজারের মতো জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে তা সরবরাহ করেছে। প্রতিটি জন্মনিবন্ধন বাবদ তারা ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। অনেকগুলো হ্যাকার চক্র সক্রিয় রয়েছে। একেকটি চক্রে ৩০ থেকে ১০০ জনের মতো সদস্য আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা জন্ম নিবন্ধনের গ্রাহক খোঁজে।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, ‘সার্ভার হ্যাক করে ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধনে ওয়ার্ড কাউন্সিলের স্বাক্ষর স্ক্যানিং করে বসানো হতো। গ্রেফতার আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুক পেইজ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাসা এবং কম্পিউটারের দোকান তেকে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে বিষয়টি তদন্ত চলছে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট দফতরে লিখিতভাবে জানিয়েছি। রেজিস্ট্রার জেনারেল এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যেসব জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু হয়েছে সেগুলো বাতিল করা হবে।’