রাশিয়ার হামলা শুরুর আগে থেকেই ইউক্রেনে অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। হামলা শুরুর পর এই দলে যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য অনেক দেশ। নেদারল্যান্ডস আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য রকেট লঞ্চার পাঠাচ্ছে। এস্তোনিয়া ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, পোল্যান্ড ও লাটভিয়া ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া চেক প্রজাতন্ত্র মেশিনগান, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল ও গোলাবারুদ পাঠাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় অস্ত্র পাঠাত না জার্মানি। রাশিয়া হামলা চালানোর পর এই দেশও ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র ও ট্যাংক-বিধ্বংসী অস্ত্র দিচ্ছে। ১৯৯৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গঠনের পর এবারই প্রথম তারা কোনো দেশে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর জন্য ‘আন্তর্জাতিক দাতা সমন্বয় কেন্দ্র’ নামে একটি উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এমন হামলা ইস্যুতে যারা আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে, সেই দেশগুলোও ইউক্রেনে সাহায্য পাঠাচ্ছে।বিজ্ঞাপন
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউর) বাইরের দেশও ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে এসব অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া ন্যাটো তার সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া ও বেলারুশের সীমান্তে পাঠাচ্ছে। প্রতিরোধব্যবস্থা জোরদার করতে এ পদক্ষেপ।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। মূলত এই অভিযানের মধ্য দিয়ে ইইউর দেশগুলোর নিরাপত্তা ইস্যুকে হুমকির মুখে ফেলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ নিয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে কথা বলেছেন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন। তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসেনি, তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে গত কয়েক দিনে। ইউক্রেনকে সহযোগিতা করতে এই ইইউর দেশগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করা হচ্ছে। যাতে সদস্যদেশগুলো ইউক্রেনকে অর্থ, অস্ত্রকে দিয়ে সহযোগিতা করে এবং নিজেদের সক্ষমতার নজির স্থাপন করে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার মাত্রা বেড়েছে। রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর দখল ও ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া দিনিপার নদীর পূর্ব পাশে যে ইউক্রেনীয় সেনারা রয়েছেন, তাঁদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। রুশ সেনাদের এ পদক্ষেপ সফল হলে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
পোল্যান্ডের সঙ্গে ইউক্রেন সীমান্ত খোলা রয়েছে। এই সীমান্ত দিয়ে বিগত কয়েক দিনে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এই অস্ত্রের পরিমাণ ঠিক কত, তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। যদি এই অস্ত্রগুলো মোতায়েন করা হয়, তবে রুশ সামরিক অভিযানে এর প্রভাব পড়বে।
ইইউর ২৭টি দেশের মধ্যে ২১টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। এই দেশগুলো সামরিক সরঞ্জাম পোল্যান্ড হয়ে ইউক্রেন পাঠাচ্ছে। তবে দেশগুলো নিজ নিজ দায়িত্বে সেখানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। এসব সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ক্ষেত্রে ন্যাটো কিংবা ইইউর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ফ্রান্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে অস্ত্র নেওয়ার ব্যাপারে ইইউর কর্মকর্তারা সমন্বয়ের কাজ করছেন। অস্ত্র কেনার জন্যও তহবিল ব্যবহার করছে ইইউ। এ তহবিলের নাম ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটি। ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এ তহবিল থেকে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ৬৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ইইউর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেনের আরও অর্থের প্রয়োজন হলে এ তহবিল থেকে তা দেওয়া হবে।
ন্যাটোর দেওয়া তথ্য অনুসারে, বেলজিয়াম, কানাডা, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, যুক্তরাজ্য, স্লোভেনিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে অস্ত্র পাঠিয়েছে বা সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ক্ষেত্রে বিল পাস করেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে অনেকে ইউক্রেনকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। ন্যাটোর অন্য সদস্যরা অস্ত্র না দিলেও ত্রাণসহায়তা ও শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে।
রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পরই পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি ইউক্রেনে গোলাবারুদ পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া হালকা মর্টার, উড়োজাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পাঠিয়েছে দেশটি। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও মলদোভা হাজারো ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে।
সুইডেন ন্যাটোর সদস্য নয়। তারা পাঁচ হাজার ট্যাংক–বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। পাঁচ কোটি মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য অস্ত্রও পাঠিয়েছে দেশটি। ফিনল্যান্ডও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। আড়াই হাজার আগ্নেয়াস্ত্র, দেড় লাখ গোলা, দেড় হাজার ট্যাংক–বিধ্বংসী অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ‘আন্তর্জাতিক দাতা সমন্বয় কেন্দ্র’ নামে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অস্ত্র পাঠানোর জন্য। ইউরোপে অতিরিক্ত ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে পাঁচ হাজার পোল্যান্ডে, এক হাজার রোমানিয়ায়, এক হাজার বাল্টিক সাগরে। এ ছাড়া ১২ হাজার সেনা প্রস্তুত রয়েছে। ন্যাটোর প্রয়োজন হলেই এই সেনারা ইউরোপে যাবেন। এ ছাড়া পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও বাল্টিক সাগরে যুদ্ধবিমান ও কপ্টার মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এস্তোনিয়ায় ন্যাটো ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্রিটিশ সেনারা। এ ছাড়া পোল্যান্ডে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাচ্ছে যুক্তরাজ্য। একই সঙ্গে আরও সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতে প্রস্তুত রেখেছে দেশটি।
পোল্যান্ডে অস্ত্র পাঠিয়েছে ফ্রান্সও। সেখানে আলোচিত রাফায়েল যুদ্ধবিমান নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সোমবার রোমানিয়ায় সেনা পাঠিয়েছে দেশটি। এই সেনারা ন্যাটোর নতুন একটি ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেবেন।
লিথুয়ানিয়ায় একটি ন্যাটো ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জার্মানির সেনারা। এ ছাড়া রোমানিয়া, স্লোভাকিয়ায় অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে দেশটি। ন্যাটোকে আরও সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। তবে এই সেনা কোথায় মোতায়েন করা হবে, সেটা বলা হয়নি। সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতে ইতালি, ডেনমার্ক, কানাডাও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোয় যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পুতিন এর পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারেন, এমন ঝুঁকিও রয়েছে। কারণ, পোল্যান্ড হয়ে যে অস্ত্রগুলো ইউক্রেনে যাচ্ছে, সেগুলো রুশ সেনাদের হত্যায় ব্যবহার করা হবে।
ন্যাটোর পদক্ষেপে রাশিয়া যে খুশি নয়, সেটা পুতিন সম্প্রতি বিভিন্ন বক্তব্যেই উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনকে সহযোগিতা করে ন্যাটো আসলে রাশিয়াকে হুমকি দিচ্ছে বা রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চাইছে।
এ সামরিক অভিযান ও পশ্চিমাদের পদক্ষেপের সঙ্গে অতীতের মিল রয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ছোট সহিংসতা থেকে। ন্যাটো যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে এমন যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টোলটেনবার্গের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘পুতিন যে সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা আমাদের সব ন্যাটো মিত্রের ওপর প্রভাব ফেলেছ। আমরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিহত করব এবং একে অপরকে রক্ষা করব।’
আবার ন্যাটো ও ইইউর পক্ষ থেকে এ–ও বলা হয়েছে, রুশ সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তাদের সেনা ইউক্রেনে যাবে না। ইউক্রেনের জনগণ যাতে নিজেদের রক্ষা করতে পারে, সে জন্য দেশটিকে সহযোগিতা করছে তারা।
পুতিনকে নিয়ে পশ্চিমাদের এখনো সংশয় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসের উপপরিচালক ম্যালকম ক্যালমার্স বলেন, ‘ইউক্রেন ছেড়ে বাকি অন্য সীমান্ত এলাকায় যদি পুতিন হামলা চালায় তবে কী হবে? বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী দমনে আমরা অভিযান চালিয়ে থাকি। পুতিনের বিরুদ্ধে এমন নয় কেন?’ এমন অস্ত্র সরবরাহ ঠেকাতে পুতিন যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারেন বলে মনে তিনি।
নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে