সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে সংগঠনটির সশস্ত্র উইংয়ে তিন থেকে চার হাজার সদস্য রয়েছে। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে অবস্থান করছে। কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন মাস। এর মধ্যে এক মাস মিজোরামে তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাকি দুই মাস মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পর্বতের কাছাকাছি এলাকায় তাদের গোপন আস্তানা থাকলেও বেশিরভাগ সদস্য বর্তমানে সাদা পোশাকে ছদ্মবেশে রয়েছে কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায়। লোকালয়ে থাকলেও মাঝে মাঝে তারা খুব অল্প সময়ের জন্য দ্রুত নিজেদের আস্তানায় ফিরে যায়। বম, পআঙ্খউয়আ, লুসাই, গুণী, ম্রো, খিয়াং নামের ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মিলে কেএনএফ গঠিত। তারা নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা মনে করে। একইসঙ্গে তারা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করে। আর এ কারণেই জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে।
কেএনএফের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথিত ‘কুকি চিন রাজ্য’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের প্রতি দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়েছে কেএনএফ। অন্যথায়, তারা দাবি আদায়ের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে নামবে বলে হুমকিও দিয়েছে। কেএনএফ বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নানা ছবি ও ভিডিও আপলোড করে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) ও ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী থাকলেও কেএনএফের মতো এভাবে সশস্ত্র গ্রুপের ঘোষণা দিতে দেখা যায় না।
প্রশিক্ষণ এবং পাহাড়ে অবস্থানের সময় কেএনএনফ’র বিভিন্ন সরঞ্জাম
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার পার্বত্য চুক্তি করে। তবে বর্তমানে পার্বত্য জেলার জেএসএস মূল, ইউপিডিএফ মূল, জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও মগ পার্টি নামে পাঁচটি সংগঠনের বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে অশান্তি ও উত্তেজনার তৈরি হয়।
কে এই নাথান বম?
কেএনএফের সভাপতি নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিপিসি) এর ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। খাগড়াছড়ির তেরাঙ্গি স্কয়ারের পাশে এম এন লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম কারিগর তিনি। কুকি চিন জাতীয় ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। এছাড়া কুকি চিনভুক্ত জাতি গোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ বইসহ ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। বম সম্প্রদায় থেকে প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।পাহাড়ে আইশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের কারণে গা ঢাকা দিয়েছেন এই নাথান বম।
যেভাবে সামনে এলো কেএনএফের তৎপরতা
২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ট্রাই জংশনের কাছাকাছি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মিজোরাম রাজ্যের লংতলাই জেলার পারভা থেকে কেনএফের ৬ সদস্য দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হয়। এর পরই আলোচনায় আসে কেএনএফের তৎপরতা। আটকের পর আসামিদের কাছে থাকা একটি চিঠিতে কোকি চীন ন্যাশনাল আর্মির সভাপতি এবং চিফ অব স্টাফের সিল মোহরসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল আরও চার জনকে আটক করা হয়।
যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
রাঙামাটি ও বান্দারবান থেকে গ্রেফতার হওয়া কেএনএফ’র বেশ কয়েকজন সদস্য
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি বৈরী মনোভাব রয়েছে কেএনএফের। পার্বত্য এলাকার ৯টি উপজেলায় স্বায়ত্তশাসন এবং পৃথক রাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে এই সংগঠনটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানে কেএনএফের সদস্যরা বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছে। তাদেরকে ধরতে পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় আমরা অভিযান চালাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘কেএনএফের প্রধান নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। আর জামায়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম সদস্য শামীন মাহফুজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে এক পর্যায়ে শামীন মাহফুজ এবং নাথান বমের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। এই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই জামায়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির আনিসুর মাহমুদকে নাথান বমের কাছে নিয়ে যান শামীম মাহফুজ। আমির আনিসুর মাহমুদ তখন নাথান বমকে জানান যে, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আসবে, তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বাবদ তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে প্রতি মাসে। আর এভাবেই জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকে অর্থ পেতে থাকে কেএনএফ।