স্টাফ রিপোর্টার: দেশ টেলিভিশন হয়ে যাচ্ছে দেশ নিউজ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অনেকগুলো খবরের মধ্যে এটি অন্যতম একটি সংবাদ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে এটি একটি আলোচনার বিষয়। কিন্তু আলোচনা হচ্ছে সরকারী মহলেও। বিশেষ করে আর মাত্র দেড় বছর পরে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রাক্কালে একটি মিক্সড চ্যানেল কেনো হঠাৎ নিউজ চ্যানেলে রুপান্তরিত হবার চেষ্টা করছে তা নিয়েও চলছে বিষদ আলোচনা।
বিশেষ করে দেশ টেলিভিশনের লাইসেন্সের মালিক কুমিল্লার এক সময়ের বিএনপির এমপি মুশফিকুর রহিমের ভাগিনা আরিফ হাসানের নামে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে লাইসেন্সটি নেয়। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে চ্যানেলটি চালুর জন্য চতুর আরিফ হাসান ভর করে আওয়ামীলীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধূরীর ওপর। পাটনার বানায় সাবের হোসেনকে। এবং চ্যানেলটি আওয়ামী ভাবাপন্ন এটি প্রমাণের জন্য বেতনভুক্ত ব্যবস্থাপনায় পরিচালক হিসেবে বেছে নেয়া হয় আসাদুজ্জামান নুরকে।
যে আসাদুজ্জামান নূর এশিয়াটিক বিজ্ঞাপন সংস্থার মত একটি বড় প্রতিষ্ঠানের ডিএমডি। তবুও একটি চ্যানেলের মোটামুটি কতৃত্ব এবং নিজেদের কোরামের নাট্য পরিচালকদের নাটক চালানো যাবে এই স্বার্থে দেশ টেলিভিশনের বেতনভুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চাকুরীটি গ্রহন করে। কিন্তু কতৃত্ব ঠিকই থাকে ডিএমডি হিসেবে থাকা দেশ টিভির লাইসেন্সধারী আরিফ হাসানের।
২০০৯সাল থেকে শুরু করে ২০২০সাল পর্যন্ত দেশ টেলিভিশনের নাম ভাংগিয়ে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করার অভিযোগ রয়েছে এই আরিফ হাসানের বিরুদ্ধে। দুদকে তার নামেও রয়েছে একাধীক মামলা। আর দেশ টেলিভিশনই শুধু নয়
সকল গনমাধ্যম কর্মীরকাছে সবচেয়ে ঘৃনীত ব্যাক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই আরিফ হাসান। কারণ বেতন ছাড়া তার টেলিভিশনের স্টাফদের ছাটাই করা ছাড়াও এ্যাটকো নামের টেলিভিশন মালিখদের সংগঠনের মিটিংয়ে উপস্থিত হয়ে কি করে গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে দূব্যবহার করতে হয় এবং বেতন ছাড়া চাকুরিতে রাখতে হয় দিনের পর দিন অন্যসব টেলিভিশন মালিকদের কাছে সেইসব অপ্রাতিষ্ঠানিক কথা বলে প্রায় সকল গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে সবচেয়ে ঘৃনীত ব্যাক্তি হিসেবে এরই মধ্যে কুখ্যাতী লাভ করেছে আরিফ হাসান।
সরকারী মহলের বক্তব্য আসছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুনভাবে তৈরী হচ্ছে আরিফ হাসান। এরই মধ্যে আসাদুজ্জামান নুরকে বাদ দিয়ে নিজে দেশ টিলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদায়ন হয়েছেন তিনি। এই তার পরিকল্পনার শুরু। এরপর বেসরকারী টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এ্যাটকোর নেতাও নির্বাচিত হয়েছেন সম্প্রতি। সেখানেও সফলভাবে বিএনপির মালিকদের সুকৌশলে পূনর্বাসিত করেছে আরিফ হাসান। আর তার সাথে সবকিছুতে সহযোগীতা করছেন বসুন্ধরার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম আনভির সোবহান।
তথ্য বলছে এ্যাটকোর আগের নেতা আওয়ামীলীগের দালাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একাত্তর টিভির এমডি মোজাম্মেল হক বাবুকে সরিয়ে আরেক বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সহকারীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বৈশাখী টেলিভিশনের ডিএমডি টিপু আলমকে বসুন্ধরার আনভির এবং দেশ টেলিভিশনের আরিফ এ্যাটকোর নির্বাচনে কৌশলে ১৯টি ভোট পাইয়ে দিয়ে এ্যাটকো থেকে মোজাম্মেল বাবুকে সরিয়ে দেয়। তারাই নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয় এ্যাটকোর। এখন এ্যাটকোর সবকিছুতেই চলে বিএনপির মালিকদের খবরদারী। সেটি বিষয় হঠাৎ করে আরিফ হাসান ঘোষনা দেয় দেশ টেলিভিশনকে নিউজ চ্যানেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। আর সেজন্য প্রয়োজন পাঁচশ কোটি টাকার। কারণ, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাক্তিদের সেংশন দেবার কারনে হয়তো সংযত হয়ে আওয়ামীলীগ গণমাধ্যমকে নির্বাচনের সময় কিছুটা ছাড় দেবে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি জামাত।
তাই বসুন্ধরার সায়েম আনভির সোবহান এবং বিএনপি জামাতের ব্যবসায়ীদের অনুদানের দেশ টেলিভিশনকে ২৪ঘন্টা একটি সংবাদ ভিত্তিক চ্যানেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। আর এসবকিছুর সমন্বয় করছেন বসুন্ধরার সায়েম সোবহান। সরকারের দূর্বলতা, সায়েম সোবহানের সাথে সরকার, হেফাজতে ইসলাম ও বিএনপির শখ্যতাসহ আরিফ হাসানের মামা মুশফিকুর রহমানের বিএনপির লবিটি কাজ করবে দেশ টেলিভিশনের দেশ নিউজে। অথচ এই আরিফ হাসানের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
কারন এই অরিফ হাসানের কানাডায় ৫০০ কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। জানা যায় আরিফ হাসান বিদেশে পাচার করা টাকায় কানাডায় বাড়ি করার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে, নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারে টরন্টোতে বাড়ি কিনেছেন আরিফ। ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছেন। এছাড়া আরিফ ও তার বাবার নামে ১২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আরিফ হাসানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে তার মালিকাধীন হাসান টেলিকমের ৩৩৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য মিলেছে।
এছাড়া আরিফ হাসান, তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজের নামে কানাডার টরেন্টোর নর্থ ইয়র্কের ৮২ হলিউড অ্যাভিনিউয়ে একটি বাড়ি কেনার তথ্য দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। জাল-জালিয়াতি করে আয় করা টাকায় বাড়িটি কেনা হয়েছে।
এর পাশাপাশি আরিফ হাসান এবং তার বাবা আবদুল আজিজের নামে ১২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সম্পদের বৈধ উৎস সম্পর্কে কোনও তথ্য জানাতে পারেননি তারা।’ অবৈধ সম্পদ অর্জন, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, অর্থপাচার আর সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আরিফ হাসানের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয় গত বছরের ১৮ নভেম্বর। ওই মাসেই তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তখন আরিফ হাসানের সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের মৌচাক শাখার ব্যাংক হিসাবে থাকা ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
এর আগে আরিফ হাসানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসানের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধ টাকা আদায় করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদকে অনুসন্ধানাধীন আছে। জানা গেছে, তিনি দেশত্যাগ করে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সুষ্ঠু অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য তার বিদেশে যাওয়া বন্ধ করা জরুরি।’
চিঠিতে আরিফ হাসানের জন্মস্থান কুমিল্লা এবং দু’টি ঠিকানা উল্লেখ করা হয়। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ এবং মায়ের নাম মালেকা পারভীন। ঠিকানা দু’টি হলো বাড়ি-১৮/এ, রোড-৪৪, গুলশান উত্তর, ঢাকা-১২১২ এবং অ্যাপার্টমেন্ট-বি-৩/ডি, বাসা-১৫, পুরাতন ডিওএইচএস, বনানী। বিশেষ পুলিশ সুপারের (ইমিগ্রেশন) কাছে চিঠিটি পাঠান দুদকের সহকারী পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) মো. শফি উল্লাহ। দুদকের অনুসন্ধান সূত্র জানায়, আরিফ হাসান ৮২ হলিউড অ্যাভিনিউ, নর্থ ইয়র্ক (টরন্টো) ঠিকানায় বাড়ি কিনেছেন।
বাড়িটি গেল বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আরিফ হাসান, তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজ ও সুফিয়া চৌধুরীর নামে হস্তান্তর হয়েছে। বাড়ি কেনার সময় আরিফ ও তার স্ত্রীর সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা সুফিয়া চৌধুরীকে অংশীদার করা হয়েছে। বাড়িটি কেনা হয়েছে ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার (২৩ কোটি ৬৩ লাখ বাংলাদেশি টাকা) দিয়ে। বাড়িটি প্রাইভেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে নগদে কেনা হয়েছে। এটি এখনও নির্মাণাধীন। ৬ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গার ওপর নির্মাণাধীন বাড়িটির কাজ সম্পন্ন করতে খরচ করা হচ্ছে কমপক্ষে ১ মিলিয়ন ডলার।
ন্যাশনাল ব্যাংক, মহাখালী শাখায় আরিফের মালিকানাধীন হাসান টেলিকমের নামে ৩৩৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। ডাইরেক্ট হোম প্রকল্পের আওতায় ৪৭৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ওয়ার্ক পারমিটের বিপরীতে ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ঋণের আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ব্যাংকের পর্ষদ সভায় হাসান টেলিকমের অনুকূলে ২৭৫ কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদি ওভারড্রাফট (ওডি) ঋণ অনুমোদন করা হয়।
২৯ নভেম্বর গ্রাহকের চলতি হিসাবে ১০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। পুরো টাকা ব্যাংকের বনানী ও দিলকুশা শাখা থেকে ১৯টি চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। ২ ও ৩ ডিসেম্বর যথাক্রমে ১০০ কোটি এবং ৭৫ কোটি টাকা একইভাবে চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে একই ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে চেকের মাধ্যমে তা নগদে উত্তোলন করা হয়। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ঋণসীমা ২৭৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৩৫ কোটি টাকায় উন্নীত করার আবেদন করেন আরিফ হাসান।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধান এখনও শেষ হয়নি। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬ বার পাসপোর্ট পরিবর্তন করা আরিফ হাসানের জাল-জালিয়াতির আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে আরিফ হাসান নিষেধাজ্ঞা ভেংগে কানাডায় অবস্থান করছেন। আগামী দশ জানুয়ারী তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।