ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি সাংসদ রাশেদ খান মেনন বলেছেন, সরকার দেরিতে হলেও নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন এনেছে, এ জন্য অভিনন্দন। তবে আইনটি অসম্পূর্ণ এবং এ কারণে বিতর্ক অব্যাহত থাকবে।
আজ বুধবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে মেনন এই মন্তব্য করেন।
মেনন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য, অর্থ, পেশিশক্তি, বিশেষ করে প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও নির্বাচন কমিশনের নিশ্চেষ্ট ভূমিকা সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে জনমনে আস্থা সম্পূর্ণ বিনষ্ট করেছে। নারায়ণগঞ্জের ব্যতিক্রমের নির্বাচন হয়েছে। দেশের মানুষ ব্যতিক্রমহীনভাবে এ ধরনের জাতীয় নির্বাচনই দেখতে চায়, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। এই সরকারকে বহাল রেখেই সেটা করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি মানা ও অর্থ, পেশিশক্তি ও প্রশাসনের ভূমিকা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ।বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন সংবিধান পর্যালোচনার দাবি জানান। তিনি বলেন, এ বছর সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি হবে। বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, তা সংসদীয় ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর আমলেই সংবিধানের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের মৌল বিষয়েরই পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আর সামরিক শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে আর পাকিস্তান আমলের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে ওই সংবিধানকে ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবাই করেছিল।
মেনন বলেন, ‘সংবিধানের দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের মৌল চরিত্র কিছুটা ফিরিয়ে আনলেও এমন সব বিধি বর্তমান, যা সরকার পরিচালনায় প্রধান নির্বাহীর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সংবিধানকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছে। বিএনপি দ্বাদশ সংশোধনীর সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান এবং সংসদীয় ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার “নাম্বার ওয়ান এমাং দ্য ইকুয়াল”
ব্যবস্থায় ফিরে আসার জন্য দেশের তৎকালীন বিরোধী দলের উপনেতা, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আমাদের প্রস্তাবগুলো মানেনি।
সেই সময়ের বিএনপির মূল নেতাদের অন্যতম বর্তমানে এলডিপির সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ সম্প্রতি এই জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিন জোটের অঙ্গীকার অনুযায়ী সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসতে বিএনপিকে বাধ্য করতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে এমনকি পদত্যাগের হুমকি দিতে হয়েছিল। সংবিধানের ৭০ বিধি সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের মতপ্রকাশের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তারা মানেনি। ফলে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন মত ব্যক্ত করতে পারেন না।’
মেনন বলেন, সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে সংবিধানের পর্যালোচনা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ জন্য এই অধিবেশনেই সংবিধানের পর্যালোচনার জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সদস্যদের নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠনের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান।
মেনন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে সাম্য ও সমতার অর্থনৈতিক নীতির কথা বারবার বলতেন ও সব সীমাবদ্ধতার পরও অনুসরণ করতেন, স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে আমরা তার যোজন যোজন দূরে পিছিয়ে গেছি। বাংলাদেশ এখন ধনীদের রাষ্ট্র, গরিবের নয়। খালি চোখেই দেখা যায় এই ধনিকদের এক ক্ষুদ্র অংশ উন্নয়নের সবকিছুতেই ভাগ বসাচ্ছে।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তৃতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকে দৃঢ় হতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু টিআইবি প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশ কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের ওপরে অবস্থান করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ফুয়েল না দিলে ফাইল নড়ে না।’ আর সেই দুর্নীতির ফুয়েলের দাম বেড়েই চলেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশে বিশাল পরিমাণ অর্থ পাচার। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে অর্থমন্ত্রী এই সত্যকে স্বীকার না করে সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চান। এর অর্থ হচ্ছে সংসদ সদস্যরা অসত্য কথা বলছেন।
মেনন বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় পাশের দেশ ভারত বা নেপাল থেকে বাংলাদেশ সফল। কিন্তু টিকা প্রদানে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ কেবল আফগানিস্তানের ওপরে। আর টিকা সংগ্রহ নিয়ে বেক্সিমকোকে একক আর্থিক সুবিধা দিতে গিয়ে অন্যত্র থেকে টিকা আমদানি চরম বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। বেক্সিমকোর নামে আমদানির টিকার হিসাবও আমরা পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে চীন আমাদের টিকা দিয়েছিল। এখনো দেশেই টিকা উৎপাদনের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, তারও কোনো ফলাফল আমরা দেখছি না।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে উপাচার্যদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ফলে তাঁদের কুকর্মের দায় তাঁর ওপরও এসে পড়ে। কিন্তু এই উপাচার্যরা কী ধরনের স্বৈরশাসক, দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠেন, চাকরিবাণিজ্যে লিপ্ত হন, তার উদাহরণ আমরা দেখেছি। বর্তমানে তাঁরা সবাই মিলে শাহজালালের উপাচার্যের জন্য দল পাকিয়েছেন। এটা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য বিব্রতকর, তেমনি সরকারের জন্যও বিব্রতকর।’
মেনন বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো নিয়ে বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো বেশ উল্লসিত। এ ব্যাপারে সরকারের মূল্যায়নটি রাষ্ট্রপতির ভাষণে থাকলে ভালো হতো। কারণ, এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বক্তব্যে মনে হয়, আমরা যেন অপরাধী। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে সব ঠিকঠাক করে নেওয়া হবে। সামনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।’
মেনন বলেন, যে মার্কিন মুলুক নিজের দেশের অভ্যন্তরে প্রতিদিন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, যারা একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পাকিস্তানিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অস্ত্র অর্থ দিয়ে সহায়তায় করেছিল আর এই সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি আটকাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন, তাঁদের বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার কথা বলার অধিকার নেই। বাংলাদেশের মানুষ এই সমস্যা নিয়ে কথা বলতে, মিটিয়ে নিতে সক্ষম।
মেনন বলেন, ‘বিএনপি যখন র্যাব সৃষ্টি করেছিল, তখন আমরাসহ আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করেছিল। আবার সেই র্যাবই যখন বর্তমান সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে, তখন জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তার প্রতিবাদ করেছে, এখনো করছে। মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডের পর সেটা আপাতত বন্ধ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই ওই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে কোনো যুক্তিতেই সমর্থন নয়, তাকে বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে।’