প্রবাসী অ্যাপ গায়েব, চক্রের পকেটে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা, জায়েজ করতে চুক্তির তোড়জোড়
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব অ্যাপ ‘আমি প্রবাসী’ হাতছাড়া হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ এ অ্যাপটি নিয়ে লোভনীয় ব্যবসার ফাঁদ পেতেছেন মন্ত্রীর এক আত্মীয়।
প্রবাসী’ হাতছাড়া হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ এ অ্যাপটি নিয়ে লোভনীয় ব্যবসার ফাঁদ পেতেছেন মন্ত্রীর এক আত্মীয়।
সরকারি অ্যাপের নাম এবং লোগো দিয়ে খোলা হয়েছে লিমিটেড কোম্পানি। ইতোমধ্যে সাড়ে ১১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রভাবশালী চক্রটি। মন্ত্রী সম্পর্কে ফুপা হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও পড়েছেন বেকায়দায়।
ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও নথিতে আপত্তি জানাতে পারছেন না। এ সুবাদে মন্ত্রীর কথিত আত্মীয় নামির আহমাদ জবরদখলের এই বাণিজ্যে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে দেনদরবার করছেন। প্রথমে সমঝোতা স্মারক করলেও এবার একেবারে চুক্তির সব বন্দোবস্ত চূড়ান্ত।
এদিকে সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলছেন, চুক্তি হয়ে গেলে ভবিষ্যতে সবাইকে দুদকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মন্ত্রী সৎ হলেও এক্ষেত্রে কেউই দায় এড়াতে পারবেন না।
জানা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রবাসী কর্মীদের সহজ তথ্যপ্রাপ্তির জন্য অ্যাপ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। নাম ‘আমি প্রবাসী’। থ্যান সিস্টেম নামের একটি কোম্পানি অ্যাপটি সরবরাহ করে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের খরচ হয় ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। গত বছর ৮ মে ভার্চুয়াল মাধ্যমে এটি উদ্বোধন করেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ।
সূত্র বলছে, উদ্বোধন হলেও অদ্যাবধি অ্যাপ বুঝে নেয়নি মন্ত্রণালয়। এ কারণে সোর্স কোডসহ অ্যাপটির পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বেসরকারি কোম্পানিটির হাতে।
এমনকি এই যখন অবস্থা, তখন মন্ত্রণালয় নিজের মালিকানা বুঝে নেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে উলটো অ্যাপ পরিচালনার জন্য তাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে, যা কোনোভাবেই বৈধ হয়নি।
এমনটি বলছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। তারা মনে করেন, সরকারি অর্থে অ্যাপ কেনার পর সেটি শতভাগ সরকারি সম্পত্তি। এক্ষেত্রে সরকারি সম্পত্তির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করাও বেআইনি।
উপরন্তু এখন আবার অ্যাপ সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। এতে বিএমইটিসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ চলে যাবে কোম্পানির হাতে।
এ সংক্রান্ত চুক্তির খসড়ায় বলা হয়েছে, অভিবাসনসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ যেমন: প্রবাসী কর্মীদের রেজিস্ট্রেশন, ট্রেনিং, প্রার্থী বাছাই, স্মার্ট কার্ড প্রদান প্রভৃতি কাজ করতে পারবে কোম্পানি।
তারা এজন্য বিভিন্ন হারে সার্ভিস চার্জ নেবে। এমনকি মালয়েশিয়ার মতো বড় শ্রমবাজারের সঙ্গে সংযোগকারী হিসাবে তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা পালন করবে কোম্পানিটি।
সূত্র বলছে, এসব অনিয়মের নেপথ্যে আছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের কথিত ভাতিজা নামির আহমাদ। অ্যাপ কেনার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সরবরাহের প্রতিটি ধাপে যুক্ত তিনি।
তার কোম্পানি থেকেই অ্যাপটি কেনা হয়। নামির আহমাদ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন মিটিংয়েও উপস্থিত হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র যুগান্তরকে জানায়, অ্যাপের আড়ালে রয়েছে শতকোটি টাকার ব্যবসা। ইতোমধ্যে কোম্পানিকে ভ্যাকসিন নিবন্ধন সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এতে কোম্পানির পকেটে ঢুকেছে অন্তত সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এখন অভিবাসনসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে তাদের সার্ভিস চার্জ আদায়ে সুযোগ করে দিচ্ছে খোদ মন্ত্রণালয়। এতে প্রবাসী কর্মীদের নির্ধারিত সরকারি ফির বাইরে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে। এতে অভিবাসন ব্যয়ও বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে একটি বেসরকারি কোম্পানিকে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া অনৈতিক এবং দুর্নীতির শামিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে লাখো প্রবাসী ইতোমধ্যে অ্যাপের দিকে ঝুঁকছে।
১১ লাখের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী নিবন্ধন করেছেন এই অ্যাপে। ফলে প্রবাসীদের বিশাল তথ্যভান্ডারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারেরও আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র বলছে, এই অ্যাপে ভ্যাকসিনের নিবন্ধন করতে গিয়ে জটিলতার মুখে পড়েছেন হাজারো প্রবাসী। নিবন্ধন সম্পন্ন না হলেও টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে অনেকের।
আবার এক জায়গায় নিবন্ধন পেন্ডিং থাকায় সুরক্ষা অ্যাপেও নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। ফলে অপেক্ষমাণ অনেকের ভিসার মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
দিনদিন ভুক্তভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের অনেকেই প্রতিদিন ধরনা দিচ্ছেন প্রবাসী কল্যাণ ভবনের সামনে। অথচ সমাধান মিলছে না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানীতে বাংলা ট্র্যাক কোম্পানির কার্যালয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেন নামির আহমাদ।
তিনি দাবি করেন, ‘অ্যাপ ডেভেলপ থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা বা প্রস্তাবিত চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পাদিত হয়েছে আইনকানুন মেনে। বরং একটি দুর্নীতিবাজ চক্র এ নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী সম্পর্কে তার ফুপা হন। কিন্তু এ সম্পর্কের খাতিরে তিনি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অবৈধ সুবিধা নেননি। বরং অভিবাসন খাতে একটি দুষ্টচক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করা হলে এ চক্রের অস্তিত্ব থাকবে না।’
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে যুগান্তর। মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামানের মাধ্যমে মন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়।
কিন্তু মন্ত্রী বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। রোববার মন্ত্রীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।