জানা গেছে, ইতিহাসের ভয়াবহতম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়েও বাজারে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্য পাচ্ছে না দেশটির সাধারণ মানুষ। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতটা দুরবস্থায় পড়েনি দেশটি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশটির রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এরমধ্যে আগামী বছরের মধ্যে ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অথচ ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে দেশটি।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকটের মধ্যে গত বছরের মার্চে শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের অনুরোধে দেশটিকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেয় বাংলাদেশ। মুদ্রা বিনিময় বা কারেন্সি সোয়াপ চুক্তির আওতায় এ অর্থ ধার দেয়া হয়। ২০২১ সালের ১৮ই আগস্ট প্রথম কিস্তিতে শ্রীলঙ্কাকে ৫ কোটি ডলার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩০শে আগস্ট আরও ১০ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়। এভাবে গত বছরের মধ্যেই দেশটিকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেয় বাংলাদেশ।
ঋণ সহায়তা দেয়ার সময় শর্ত ছিল, প্রথম কিস্তি পরিশোধ করার জন্য শ্রীলঙ্কা ৩ মাস সময় পাবে। এ সময় সুদের হার হবে লাইবরের (লন্ডন আন্তঃব্যাংক সুদের হার) সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ। প্রথম ৩ মাসে ঋণ শোধ করতে না পারলে শ্রীলঙ্কাকে আরও ৩ মাস সময় দেয়া হবে। দ্বিতীয়বারের ৩ মাসেও সুদের হার সমান থাকবে। তবে ৬ মাস পার হওয়ার পর থেকে পরের ৩ মাসে সুদের হার হবে লাইবরের সঙ্গে অতিরিক্ত ২.৫ শতাংশ।
শর্ত অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট হিসাবে ২৫ কোটি ডলার পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই হিসাবে আগে থেকেই ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৪৯.৫ বিলিয়ন শ্রীলঙ্কান রুপি জামানত হিসেবে জমা রাখে শ্রীলঙ্কা। কথা ছিল পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কা ওই হিসাবে ডলার জমা দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করবে। প্রতি বছর ৫ থেকে সাড়ে ৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে এ আমদানি পণ্যের মূল্য ওই হিসাবে জমা থাকা শ্রীলঙ্কান মুদ্রা দিয়ে পরিশোধ করা হবে।
কিন্তু শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ ঋণের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে সেটিও ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে মাত্র ৪৬৩ কোটি টাকার পণ্য। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৩২৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
ওদিকে আগের ঋণ পরিশোধ না করলেও কারেন্সি সোয়াপের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আরও ২৫ কোটি ডলার চেয়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় দেশটিকে নতুন করে আর কোনো ঋণ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিলে তা ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আগের দেয়া ২৫ কোটি ডলার আদায় নিয়েও সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া বড় বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এ অবস্থায় রিজার্ভ থেকে ডলার ধার দেয়ার ঝুঁকি নেবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি আরও ঋণ চেয়ে করা শ্রীলংকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এ অর্থ দিয়ে এক মাসের প্রয়োজনীয় আমদানি চালানোও মুশকিল হয়ে উঠেছে দেশটির জন্য। আবার চলতি বছরেই দেশটিকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও বিদেশি ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে, দেশটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। বরং পুরনো ঋণের দায় মেটাতে এক প্রকার বিনামূল্যেই পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে দেশটিকে। এরইমধ্যে ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আড়াইশ’ মিলিয়ন ডলার পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর বিনিময়ে প্রতি মাসে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চা ইরানে রপ্তানির মাধ্যমে এ অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণটির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ, শ্রীলঙ্কার ভৌত অবকাঠামো খাতে নির্মাণ ও উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করেছে চীন। দেশটির মোট বৈদেশিক ঋণের ১০ শতাংশের জোগান এসেছে চীন থেকে।