রবিবার , ৮ মে ২০২২ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
TableTalkUK
  1. ক্রাইম সিন
  2. খেলাধুলা
  3. জেলার খবর
  4. তথ্য-প্রযুক্তি
  5. প্রবাসের কথা
  6. বাংলাদেশ
  7. ব্যাবসা-বাণিজ্য
  8. ভিডিও সংলাপ
  9. মিডিয়া
  10. শিক্ষাঙ্গন
  11. সকল সংবাদ

বিমানের অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে

প্রতিবেদক
ukadmin
মে ৮, ২০২২ ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

যাত্রী কেবিনে ভারী কার্গো বহন করার ঘটনায় জড়িতরা আছেন বেশ বহাল তবিয়তে। যাদের দায়িত্বহীনতার কারণে বিমান বাংলাদেশ বহরের ৮টি উড়োজাহাজের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তাদের কিছুই হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করেনি রাষ্ট্রীয় এই বিমান সংস্থাটি। উলটো ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কারও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কেউ পেয়েছেন ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। অভিযুক্তদের অনেককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বড় বড় পদে।

‘বিমানের যাত্রী কেবিনে কার্গো পরিবহণ-ক্ষতি হাজার কোটি টাকা’ শিরোনামে ১২ ফেব্রুয়ারি  অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল। সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য ও ছবির বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়া উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইয়ার, ২টি বোয়িং ৭৩৭ এবং ২টি ভাড়ায় আনা এয়ারক্রাফট। এ ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজে ক্ষতির পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, ভাড়ায় আনা বিমানগুলো বিমান কর্তৃপক্ষ কিনে নিতে বাধ্য হয়। কেননা, যাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল তারা মেরামত করে দিলেও ফেরত নিতে চায়নি। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ব্যাখ্যার উত্তরেও অসত্য তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত সত্য গোপন করে বিমানের ব্যাখ্যায় বলা হয়, করোনার ভ্যাকসিন পরিবহণ করতে গিয়ে বিমানের কয়েকটি উড়োজাহাজের ক্ষতি হয়েছে। সিটের হাতল ভাঙাসহ কিছু মুভি সেট নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিসাধন হয়েছে কিছু ইন্টেরিয়রের, যা বিমানের নিজস্ব হ্যাঙ্গারে মেরামত করে বিমানকে চলাচলের উপযুক্ত (এয়ারওয়ার্দিনেস) করে রাখা সম্ভব হয়েছে। এমনকি বিমানের ব্যাখ্যায় ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ‘ভ্যাকসিন হিরো’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

অথচ  নিজস্ব অনুসন্ধান, বিমানের পাইলট, কেবিন ক্রু, কার্গো ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালীন একটি ভ্যাকসিনও বিমানের যাত্রী কেবিনে বহন করা হয়নি। ভ্যাকসিনবাহী ব্যাগেজগুলো আনা হয়েছিল বিমানের আন্ডারগ্রাউন্ড কার্গো ও কনটেইনার হোলে। টিকা বহনের কারণে বিমানের কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের এয়ারলাইন্সও একই নিয়মে তাদের কার্গো হোলে ভ্যাকসিন পরিবহণ করেছে।

মূলত বিমানের যাত্রী কেবিনে অপরিকল্পিতভাবে কার্গো পণ্য পরিবহণ করতে গিয়েই ৮টি উড়োজাহাজের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। যেসব ক্ষত নিয়ে এখনো বিমানের অনেক উড়োজাহাজ আকাশে উড়ছে। অধিকাংশ মুভি সেট এখনো অকেজো হয়ে আছে। ব্যয়বহুল ও স্পেয়ার পার্টস না থাকায় এগুলো সচল করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-যাত্রী কেবিনে কার্গো বহন করায় উড়োজাহাজের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি লোকসান হতো বিমানগুলো না উড়িয়ে হ্যাঙ্গারে বসিয়ে রাখলে। তাছাড়া করোনাকালীন বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ ছিল। সে সময় যাত্রী কেবিনে কার্গো পরিবহণ করা হয়। আর সে মুনাফা দিয়ে এয়ারলাইন্সকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যায় এভাবে ফ্লাইট চালিয়ে কত টাকা লাভ হয়েছে, সেটি উল্লেখ করা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনাকালীন বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইন্সই শুধু কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। কিন্তু কোনো এয়ারলাইন্সের বিমানের মতো উড়োজাহাজের ক্ষতি হয়নি। বাংলাদেশ থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্স, কাতার ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সও তাদের উড়োজাহাজে কার্গো পরিবহণ করেছে। কিন্তু তাদের এয়ারক্রাফটেরও কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে শুধু বিমানের। এর নেপথ্যে কারণ হলো-বিমানের বেশিরভাগ ফ্লাইটে অফিসিয়ালি যে পরিমাণ কার্গো পরিবহণ করার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি কার্গো পরিবহণ করা হয়েছে। এ কারণে অপরিকল্পিতভাবে এবং যেখানে যেভাবে পেরেছে সেখানে কার্গো পণ্য রাখতে গিয়ে বিমানগুলো ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিমানেরই একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এ অনিয়ম আর খামখেয়ালির সঙ্গে জড়িত। সিন্ডিকেটের মূল হোতা ছিলেন বিমানের এক পরিচালক। যাকে পুরস্কার হিসাবে সম্প্রতি আরও এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি এতটাই প্রভাবশালী যে একজন আবহাওয়াবিদ হয়েও তাকে বিমানের পরিকল্পনা, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস এবং ফাইন্যান্স শাখার প্রধান করা হয়। তিনি নিজকে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে পুরো বিমানকে নিজের কব্জায় নিয়েছেন। তার ইশারা ছাড়া বিমানে কোনো কাজ হয় না। অভিযোগ রয়েছে, ওই প্রভাবশালী কর্মকর্তা একাধারে পরিকল্পনা ও ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হওয়ায় করোনাকালীন বিমানের আর্থিক আয়-ব্যয়ে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছিল না। তিনি নিজে পরিকল্পনা বিভাগে থেকে সব ধরনের এয়ারক্রাফট কেনাবেচা ও লিজ গ্রহণসহ বড় বড় প্রকল্পের কেনাকাটা করতেন। ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে কোনো ধরনের অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি ছাড়া বিলও পরিশোধ করতেন। এভাবে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া করোনাকালীন বিমানের শত শত কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রভাবশালী পরিচালকের নেতৃত্বে করোনাকালীন কার্গো ব্যবসা করার জন্য শুরুতে একটি নির্দিষ্ট দরে সিন্ডিকেট পুরো ফ্লাইটটি (কার্গো কেবিন ও যাত্রী কেবিন) কিনে নিতেন। এরপর আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো কার্গো ভর্তি করতেন বিমানে। যাত্রী কেবিনে কার্গো উঠানোর নির্ধারিত বিধিবিধান অনুসরণ করেননি সিন্ডিকেট সদস্যরা।

সূত্র জানায়, লোডাররা কার্গো মাথায় করে এনে বিমানের সিটের ওপর আছড়ে ফেলতেন। যাত্রী কেবিনে কার্গো রাখার নিয়ম হলো-একটি আসনের যতটুকু জায়গাজুড়ে একজন মানুষ বসতে পারেন, ঠিক ততটুকু মাপের লাগেজ বানাতে হবে। একজন মানুষের যত ওজন, লাগেজগুলোর ওজন হতে হবে তার অর্ধেক। দুই আসনে দুটো লাগেজ বসিয়ে সিট বেল্ট দিয়ে লাগেজগুলো বেঁধে দিতে হবে। আকাশে বিমান নড়াচড়া করলেও যেন লাগেজগুলো পড়ে না যায়।

কিন্তু সিন্ডিকেট চক্র পুরো ফ্লাইট কিনে নেওয়ায় নিজেদের ইচ্ছামতো লাগেজ লোড করত। যাত্রী কেবিনে কাপড় কিংবা নরম কার্গো পাঠানোর নিয়ম থাকলেও সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের ইচ্ছেমতো শক্ত ও ভারী মালামাল লোড-আনলোড করেছে। একটি সিটে সর্বোচ্চ ৩০ কেজি ওজনের (একজন মানুষের ওজনের অর্ধেক) লাগেজ দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো কোনো লাগেজ ১০০ কেজিরও বেশি ছিল।

এছাড়া ভারী লাগেজগুলো লোডাররা মাথার ওপর থেকে সিটের ওপর আছড়ে ফেলার কারণে হাতলের পাশাপাশি সিটের পেছনে থাকা অনেক মুভি সেটও (সিনেমা দেখার সেট) ভেঙে গেছে। লাগেজে সিট বেল্ট না লাগানোর কারণে আকাশে লাগেজগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কোথাও জানালার শাটার, কোথাও খাবার রাখার ট্রে,আবার কোথাও সিটও ভেঙে গেছে। ফ্লাইটগুলোতে কেবিন ক্রুরা থাকলেও তারা কোনো অভিযোগ করতে পারতেন না। লোডাররা সিটের হাতলের ওপর দাঁড়িয়ে হ্যান্ডব্যাগ রাখার বিনে লাগেজ রাখতেন। এভাবে অসংখ্য হাতল ভেঙে গেলেও অজ্ঞাত কারণে কর্তব্যরত ক্রুরা প্রতিবাদ করতে পারতেন না।

কিছু কিছু দেশ থেকে কার্গো আনার সময় যাত্রী কেবিনে এতটাই নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত কার্গো রাখা হতো যে-এসব বহন করতে চাইতেন না ওই দেশের লোডাররা। তখন সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঢাকা থেকে লোডার নিয়ে ফ্লাইটে কার্গো লোড-আনলোড করতেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কার্গো পরিবহণের জন্য একটি বেসরকারি কোম্পানি গঠন করা হয়। যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয় বিমানের সাবেক একজন পরিচালককে। ওই পরিচালক যখন বিমানে কর্মরত ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে ১৫০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করা হয়। অপরদিকে, ওই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসাবে ছিলেন বিমানের সেফটি বিভাগের একজন পাইলটের স্ত্রী, যিনি বর্তমানে বিমানের পাইলট হিসাবে চাকরি করছেন।

বিমান লিজ নিয়ে বড় প্রশ্ন : এদিকে বিমানের নিজস্ব এয়ারক্রাফট বসিয়ে রেখে এবারের হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বিদেশি এয়ারলাইন্স থেকে ২ উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট। খোদ বিমান পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য যুগান্তরকে বলেছেন, বিমানের লাভের কথা না ভেবেই নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য একটি সিন্ডিকেট একটি বিদেশি এয়ারলাইন্স থেকে ২টি এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

তারা বলছেন, এমনিতে এ বছর হজ যাত্রী কম থাকায় এয়ারক্রাফট লিজের প্রয়োজন নেই। উপরন্তু, উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ দুটি এয়ারবাস এ-৩৩০ ইজারা নেওয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ বহরের পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকার পরেও এভাবে দুই বিমান লিজ নেওয়ায় বিমানের কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা গেছে, ৩০ এপ্রিল বিমানের ২৭৬তম বোর্ড সভায় লিথুয়ানিয়াভিত্তিক ‘হেস্টন এয়ারলাইন্সের’ সঙ্গে এ বিষয়ক একটি চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মাত্র আটজন বোর্ড সদস্য এবং বাংলাদেশ বিমানের করপোরেট প্ল্যানিং অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের পরিচালক মাহবুব জাহান খানসহ আরও তিন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আকস্মিক এ সিদ্ধান্তের কারণে সর্বস্তরের কর্মকর্তাসহ পর্ষদের অন্যান্য বোর্ড সদস্য ও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, চলতি বছরের হজ ফ্লাইটের জন্য করপোরেট প্ল্যানিং অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের পরিচালক মাহবুব জাহান খান এই দুটি এয়ারবাস লিজের প্রস্তাবনা জমা দেন। পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ এবং গবেষণা না থাকায় সেটি প্রত্যাখ্যান করা হয় পর্ষদ সভায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে গত সপ্তাহে ফের পরিচালক মাহবুব জাহান খান এজেন্ডা ছাড়া ওই প্রস্তাব বোর্ডে উঠায় এবং সেটি পাশ হয়।

সর্বশেষ - ব্যাবসা-বাণিজ্য