বাংলাদেশ বিমানে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৪ পাইলটের মধ্যে ক্যাপ্টেন মেহেদী আল ইসলামের এটিপিএল (এয়ারলাইন ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স) সনদ জাল। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে সনদটি তৈরি করেছেন। এটি জমা দিয়ে মেহেদী বিমানে যোগদান করেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। বেবিচকের অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ঘটনায় মেহেদীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়েছে বেবিচক।
জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত অন্যদের অবস্থাও খুব ভালো নয়। অধিকাংশেরই বিমান চালানোর ভালো অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা নেই। ৮ জন পাইলটের মধ্যে ২ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। ১৪ জনেরই বিরুদ্ধে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ট্রেনিংয়ে ফেল, দুর্ঘটনা ঘটানো এবং চাকরিচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। নিয়োগকৃত এক পাইলট (ফার্স্ট অফিসার) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি পরিবারের সদস্য। এসব ঘটনায় বিমানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকেও বিমানের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, দুটি বিষয়ই তিনি শুনেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশনের লিখিত কোনো চিঠি পাননি। বেবিচকের চিঠি পাওয়ার পরই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের এক কনসালটেন্স বলেন, বিমানের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তারা দীর্ঘ তদন্ত করে ক্যাপ্টেন মেহেদী আল ইসলামের এটিপিএল সনদ আছে এমন কোনো প্রমাণ পাননি। তিনি বলেন, এটিপিএল সনদ সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট সেফটি বিভাগ দিয়ে থাকে। মেহেদী যে লাইসেন্স জমা দিয়েছেন, সেটি তাদের দেওয়া সনদ নয়। লাইসেন্সে যে স্বাক্ষর আছে, সেটিও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এক সপ্তাহ আগে বিমানের এমডির কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছেন। অপরদিকে ক্যাপ্টেন রুবাব ও মাসফিকের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দিলেও বিমান সেটি কার্যকর করেনি বলে তিনি জানান। বর্তমানে দুই পাইলট বিমানের ড্যাস-৮ কিউ মডেলের উড়োজাহাজ চালাচ্ছেন।
বেবিচকের অপর এক তদন্তে দেখা যায়, তাদের অনুমতি ছাড়া দুই ক্যাডেট পাইলটকে রুট ট্রেনিং করিয়েছে বিমান। দুই পাইলটরে নাম রুবাব হোসেন ও মাসফিক নিয়াজ। সাধারণত যাত্রী নিয়ে আকাশে উড়া কমার্শিয়াল ফ্লাইটে এই ট্রেনিং করানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিমান এক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছে। অভিযোগ-বিমানের চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদ দুটি ঘটনার জন্য দায়ী। এজন্য বেবিচক সংশ্লিষ্ট পাইলট ও চিফ অব ট্রেনিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এসব ঘটনার কোনো তদন্ত পর্যন্ত করেনি।
জানা যায়, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১৪ পাইলট নিয়োগ দিয়েছে বিমান। নিজদের খরচে সেই পাইলটদের থাইল্যান্ড থেকে ট্রেনিংও করিয়ে এনেছে। যদিও বিমানের ইতিহাসে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা পাইলটের ট্রেনিং নিজদের খরচে করার রেকর্ড নেই। এখানেও অভিযোগের আঙুল উঠেছে চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদের বিরুদ্ধে। তিনি নিজের স্ত্রীকে বিমানের খরচে ট্রেনিং করানোর জন্য এই কাজটি করেছেন। ফাইলের যে অংশে নিজদের খরচে ট্রেনিংয়ের কথা বলা আছে, ক্যাপ্টেন সাজিদ ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার আগে সেটি ফেলে দিয়েছিলেন। বিমান ম্যানেজমেন্টের বেশির ভাগ পরিচালক নতুন হওয়ায় তারা বিষয়টি না জেনে ফাইল অনুমোদন করে দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে বিমানকে ৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চা দিতে হয়েছে। সাজিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তার স্ত্রীর (ক্যাপ্টেন সাদিয়া আহমেদ নাতাশা) সিমুলেটর ট্রেনিং চলাকালে তিনি ৩ দিনের অফিসিয়াল ছুটি নিয়ে ব্যাংকক গেছেন। সেখানে ৩ দিনের পরিবর্তে তিনি ৭ দিন অবস্থান করেন। অভিযোগ আছে, ব্যাংকক অবস্থানকালে তিনি নিজের স্ত্রীর সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে সহযোগিতা করেছেন।
ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদ পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, বিমানে পাইলট নিয়োগে তার কোনো হাত ছিল না। তার স্ত্রী সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতাবলে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, কোনো পাইলটই এ ধরনের পরীক্ষায় একবার পাশ করার রেকর্ড নেই। আর এটা কোনো অপরাধও নয়।
অভিযোগ উঠেছে যাত্রী কেবিনে কার্গো পণ্য বহন করে বিমানের ৮ এয়ারক্রাফটের ভয়াবহ ক্ষতির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের এক প্রভাবশালী সদস্য নিয়োগ পেয়েছেন পাইলট হিসাবে। তিনি এই ১৪ জনেরই একজন। কার্গো পণ্য পরিবহণের জন্য সিন্ডিকেট যে কোম্পানি গঠন করেছিল, তার অফিসিয়াল সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ছিলেন ওই কো-পাইলট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, জাল সনদ জমা দেওয়ার ভয়ে ক্যাপ্টেন মেহেদী এখনো রুট ট্রেনিং করেননি। নিয়ম অনুযায়ী রুট ট্রেনিং করতে সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি লাগে। এ মুহূর্তে তার পক্ষে আর রুট ট্রেনিং করা সম্ভবও হবে না। কারণ সিমুলেটর পরীক্ষায় পাশ করার পর ২৮ দিনের মধ্যে রুট ট্রেনিং সম্পন্ন করতে হয়। অন্যথা সিমুলেটরের কার্যকারিতা থাকে না। ২৮ দিন পার হয়ে গেলে ওই পাইলটকে ফের সিমুলেটর পরীক্ষা দিতে হবে। বিমানের তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, সিমুলেটর শেষে ২২ মে মেহেদী থাইল্যান্ড থেকে ঢাকা ফেরেন। এ হিসাবে তার সিমুলেটরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০ জুন। এখন রুট ট্রেনিং করতে হলে তাকে আবারও সিমুলেটর পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।
এদিকে মেহেদীর রুট ট্রেনিং না হওয়ায় বিপাকে পড়েছে বিমানের ট্রেনিং ও ফ্লাইট অপারেশন বিভাগ। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে মেহেদীর সিমুলেটর ট্রেনিংয়ের পেছনে বিমান যে ২০ লাখ টাকা খরচ করেছে, ওই টাকা কীভাবে আদায় করা হবে। বিমানের সর্বশেষ সিমুলেটর পরীক্ষা হয় ২০১৭ সালে। তখন যেসব পাইলট সিমুলেটর পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে বিমান জনপ্রতি ৮ হাজার মার্কিন ডলার জমা রেখেছিলেন। যদি কোনো কারণে কোনো পাইলট ফেল করে কিংবা সিমুলেটর শেষে বিমানে যোগদান না করে, তাহলে ওই টাকা থেকে বিমান সমন্বয় করবে। কিন্তু এবার বিমান ১৪ পাইলটের কারও কাছ থেকে কোনো টাকা জমা রাখেনি। সিমুলেটর পরীক্ষার ফি বেড়ে যাওয়ায় এবার কমপক্ষে ২২ হাজার ডলার জমা রাখার কথা ছিল। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে এবার কোনো টাকাই জমা রাখা হয়নি। এ অবস্থায় মেহেদীর পেছনে খরচ হওয়া টাকা কোথা থেকে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।