নিজস্ব প্রতিবেদক: মামুন মাহমুদ শাহ। এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই ব্যাংকার সম্পর্কে যতদুর জানাযায় মামুন মাহমুদ শাহ এক সময় বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। যেমন এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক, স্টান্টার্ড চাটার্ড ব্যাংক, এরপর ইবিএল এ কিছুদিন কাজ করেছেন তারপর প্রিমিয়ার ব্যাংক হয়ে জিএসপি ফাইনান্সের কাজ করেছেন এরপর এনআরবি ব্যাংকের ডিএমডি পদে যোগদান করে তিনি এমডিকে সরিয়ে নিজেই এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। তার সম্পর্কে ব্যাংক পাড়ায় বলা হয়ে থাকে তিনি কর্মী বান্ধব নন। তার নির্দেশ কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা পালন করতে যেয়ে কোনো ধরনের বিপদের সম্মুখীন হলে মামুন মাহমুদ শাহ পরে আর দায়িত্ব নেন না। এবং মি. শাহ যে ব্যাংকেই যোগদান করে কাজ শুরু করেছেন সেখানে নানা ধরনের বিপত্তি এসে জড়ো হয়।
উদাহরন স্বরুপ ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একসঙ্গে যে নয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়, তার একটি হলো এনআরবি ব্যাংক। একই সময়ে কার্যক্রম শুরু করা অন্য অনেক ব্যাংকের তুলনায় বেশ পিছিয়ে পড়েছে ব্যাংকটি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এনআরবি ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। একই সময়ে ৩ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছর শেষে এনআরবি ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। যদিও চতুর্থ প্রজন্মের অনেক ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ অনেক আগেই ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
তবে এই মামুন মাহমুদ শাহ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবার পর গত বছর এনআরবি ব্যাংককে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করায় ব্যাংকটিকে এ জরিমানা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, শেয়ারবাজারে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৯৯১ এর (২৬ক (১) ধারা লঙ্ঘন করায় এনআরবি ব্যাংকের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হয়নি। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর (২৬ক (১) ধারা লঙ্ঘনের জন্য একই আইনের ২৬ক(৩) ধারার আওতায় মোট ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো।
সেখানে আরো বলাহয় আরোপিত জরিমানা পত্র দেওয়ার তারিখ হতে তিনদিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিল অফিসে রক্ষিত সাধারণ হিসাব প্রধান কার্যালয়ে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আর যথাসময়ে জরিমানার অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এনআরবি ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে বিকলনের মাধ্যমে জরিমানার টাকা আদায় করা হবে।
তাছাড়া মামুন মাহমুদ শাহ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবার পর করোনা কালে এবং পরে বহু কর্মী তিনি ব্যাংক থেকে ছাটাই করেন। যদিও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ দাবী করেন কোনো কর্মীকেই চাপ দিয়ে কিংবা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে এনআরবি ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য করা হয়নি। যারা এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই অপেক্ষাকৃত ভালো চাকরি পেয়ে ব্যাংক ছেড়েছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনআরবি ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং চাকরিচ্যুতরা ভিন্ন কথাই বলছেন।
সম্প্রতি এনআরবি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ইমতিয়াজ আহমেদকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরি হারানো এ ব্যাংকার বর্তমানে বেকার। বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ব্যাংকটির কোম্পানি সেক্রেটারি হাসানুল হককে। চাকরি হারিয়েছেন ব্যাংকটির ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স (আইসিসি) বিভাগের প্রধান বাদল কুমার নাথ। চাকরি ছাড়ার চাপে আছেন ব্যাংকের করপোরেট বিভাগের প্রধান শহিদুল ইসলাম, এসএমই বিভাগের প্রধান শফিউল আজম, ঋণ প্রশাসন বিভাগের প্রধান এএইচএম মোরশেদ, ঋণঝুঁকি বিভাগের প্রধান মশিউর রহমান।
মাত্র তিন মাস আগে শরিয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংক থেকে এনআরবি ব্যাংকে এসেছেন আবুল কাশেম মো. ছফিউল্লাহ। তিনি ব্যাংকটির ইসলামিক ব্যাংকিং ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকেও নতুন চাকরি খুঁজতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে হতাশায় আছেন এ ব্যাংক কর্মকর্তা।
আর বর্তমান এমডিরই কারনে পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনাবেচায় কারসাজির ঘটনায় এনআরবি ব্যাংকের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনায় ব্যাংকটিকে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি শেয়ার কারসাজিতে জড়িত কর্মীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যাংকের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সিএফও) কামরুল হাসানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যদিও ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ব্যাংকের যেকোনো বিনিয়োগের জন্য অন্তত তিনটি কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিএফও চাকরিচ্যুত হয়েছেন, সেটির সঙ্গে এনআরবি ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মামুন মাহমুদ শাহসহ নেতৃস্থানীয় অনেকেই জড়িত। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
অনৈতিকভাবে শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে এনআরবি ব্যাংকের বিনিয়োগ ব্যাংকিং ইউনিটের সব সদস্যসহ প্রধান অর্থ কর্মকর্তার (সিএফও) বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একই সঙ্গে গোপনীয় নথিপত্র সংরক্ষণে ব্যর্থতার জন্য এনআরবি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুম মাহমুদ শাহের কাছে পাঠানো চিঠিতে এসব নির্দেশনা দিয়েছে বিএসইসি। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে অসঙ্গতি এবং অন্যান্য অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে এনআরবি ব্যাংককে এমন নির্দেশনাসহ বেশকিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বিএসইসিকে অবহিত করার জন্য এনআরবি ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কারনে ব্যাংকটির বনানী শাখার ব্যবস্থাপক সাইফুদ্দিন সরকার, উত্তরা শাখার ব্যবস্থাপক আকতার হোসেন, ধানমন্ডি শাখার ব্যবস্থাপক এবিএম মোরশেদ, চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক নুর এ আলম খন্দকার চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। একই সময়ে ব্যাংকের এফএভিপি এনএম শফিউল আজম খান, এসভিপি তারেকুজ্জামান, এসপিও তারেক আনোয়ার বিন রশিদ, রইস উদ্দিন, সায়েমা কামাল, কাজী আহনাফ সাকিবসহ দেড় শতাধিক কর্মকর্তা পদত্যাগের চাপ কিংবা বিভিন্ন কারণে এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছেন।
করোনার কারণে গত বছর বন্ধ ছিল এনআরবি ব্যাংক কর্মীদের পদোন্নতি। তবে ১৬৬ জন কর্মকর্তাকে এমডি নানা ধরনের সুযোগ আর প্রতিশুতি এবং উপঠৌকন নিয়ে পদোন্নতি দিয়েছে ব্যাংকটি। যদিও এ পদোন্নতি নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি উঠেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা লঙ্ঘনেরও ঘটনা ঘটেছে। এমন ১৪ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকেই বিভাগীয় তদন্ত ও শাস্তি চলছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যরা উপেক্ষিত হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় পুরো পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়েই ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগ ও আমানত দক্ষতার সঙ্গে দেশে কাজে লাগানোর জন্য নয় বছর আগে কার্যক্রম শুরু করে এনআরবি ব্যাংক। তবে প্রথম থেকেই সে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠান। কখনো শেয়ার কারসাজিতে জড়িয়ে গুনতে হয়েছে আর্থিক জরিমানা, আবার কখনো সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে নিয়ম ভেঙে। আছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। কর্তৃত্ব ধরে রাখতে নিজস্ব বলয় তৈরি নিয়ে ব্যস্ত শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি অংশ। ব্যাংকিং কার্যক্রমে তাই সমন্বয় নেই। সব মিলিয়ে মহাসংকটে চতুর্থ প্রজন্মের অন্যতম এ তফসিলি ব্যাংক। চাকুরীচূত্য ব্যাকটির সাবেক কর্মকর্তারা জানান ব্যাংকটির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মামুম মাহমুদ শাহ থাকলে এনআরবি ব্যাংক আর উঠে দাড়াতে পারবেনা।