মহামারির গেল দুই বছরের কঠিন সময়ে রোগী ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের ভীতি যেমন ছিল, তেমনি শুরুতে সংকট ছিল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), হাসপাতালের ট্রায়াজ সিস্টেম, ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আইসিইউ শয্যাসহ জরুরি সব চিকিৎসা সামগ্রীর। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ধীরে ধীরে এসব সংকট কাটিয়ে উঠেছে। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থপনা নিয়ে। দুই বছর পার হলেও সেই অব্যবস্থাপনা থেকে বের হতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর, তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি শুরুর পর থেকে নিয়ন্ত্রণে কোনও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা এবং ভুল পদক্ষেপের কারণে দেশে মহামারি প্রকট আকার ধারণ করেছিল, সেইসঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে অনিহা। আর এই সমন্বয়হীনতা সবশেষ নজির গত ২৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া গণটিকাদান কর্মসূচিতেও দেখা গেছে। এই অব্যবস্থাপনা থেকে স্বাস্থ্য বিভাগ কবে বের হবে বা আদৌও বের হতে পারবেন কিনা প্রশ্নও তুলেছেন তারা।
আজ ৮ মার্চ— দেশে করোনা মহামারির দুই বছর। ২০২০ সালের এ দিন দেশে তিন জন করোনা আক্রান্ত রোগীর খবর জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর ঠিক ১০ দিন পর করোনা আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুর কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। করোনার শুরুতেই চিকিৎসকরা মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিপি) নিয়ে অভিযোগ করেন। তাদের যেসব সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে সেগুলো মানসম্পন্ন নয় বলে অভিযোগ তোলেন তারা। যার কারণে অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হন। মারা যান দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ জেষ্ঠ্য চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়শনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘অনেক প্রথিতযশা চিকিৎসককে আমরা করোনায় হারিয়েছি, যাদের রিপ্লেসমেন্ট কোনও দিন হবে না। বড় বড় চিকিৎসককে হারিয়েছি—এটা অপূরণীয় ক্ষতি। শুরু থেকে হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর নামে নিম্নমানের সামগ্রী দেওয়া না হলে হয়তো এত চিকিৎসকের মৃত্যু হতো না। বিশেষ করে আইসিইউতে যদি সঠিকভাবে সুরক্ষা মেনে চলা যেতো তাহলেও এত ডাক্তার মারা যেতেন না।’
গত দুই বছরে দেশে ডেল্টা ও ওমিক্রণের তাণ্ডব দেখেছে দেশ। কিন্তু শুরুর থেকেই যতি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে এত মানুষ আক্রান্ত এবং এত মৃত্যু হতো না। এখানেও অব্যবস্থাপনার কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সেসময় করোনা নিয়ন্ত্রণে গোঁজামিলের কথাও বলেন তারা।
গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনার ঊর্ধ্বমূখী সংক্রমণ শুরু শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় পাঁচ এপ্রিল থেকে মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এ বিধিনিষেধের ফলাফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঈদুল ফিতরে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে পড়ে। আর এতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, সংক্রমণের ‘পিক টাইম’-এ এ ধরনের ঘোষণা আমাদের আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে।
২০২১ এর ৮ মে দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। মহামারিকালের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ের এপ্রিলকে ছাড়িয়ে জুন হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ভয়ংকর এ পরিস্থিতির ভেতরেই সংক্রমণ রুখতে ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। কিন্তু ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন শিথিল করে সরকার। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা সেসময় বলছেন, শিথিলতার এ নির্দেশনায় তাদের ‘সায়’ ছিল না। তারা বলছেন, সরকারের শিথিল বিধিনিষেধের এ ঘোষণা তাদের পরামর্শের উল্টো চিত্র। এ সময় এ ধরনের শিথিলতা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ারই শামিল।
‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে। তবে সেটা ভুল করে নয়। সিদ্ধান্ত নিয়েই ভুল পথে হেঁটেছে’— এ মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস। তিনি বলেন, ‘মহামারি যখন আসে তখন মহামারি বিশেষজ্ঞদের নিয়েই কাজ করতে হয়, তাদের মতামত-অভিজ্ঞতা শুনে এগোতে হয়। কিন্তু সেটা করা হয়নি। না হওয়ার কারণেই মানুষকে তার মূল্য দিতে হয়েছে, এত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এসব কিছুর মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থপনা।
এখন করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বটে, তবে ভবিষ্যতে আবার কোনও ভ্যারিয়েন্ট যখন আসবে তখনও এই অব্যবস্থাপনাই দেখা যাবে। কারণ গত দুই বছরেও এসব অব্যবস্থাপনার জন্য কাউকে কোনও জবাবদিহি করতে হয়নি, জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি, বলেন ডা. চিন্ময় দাস।
দেশে করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েও অব্যবস্থাপনার উদাহরণ রয়েছে। দেশে টিকাদান কর্মসূচিতে ভোগান্তি পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে গিয়ে মানুষকে হয়রানি হতে হয়েছে। তারে করে টিকা নিতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মানুষ। আবার টিকা নিতে গিয়ে মানুষ হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে; অনেকে লাঠিপেটার শিকারও হয়েছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে থেকেও কেউ কেউ টিকা পাননি। আবার কেউ পরে এসে আগে টিকা নিয়ে চলে গেছেন। অনেকে আবার একদিনেই পেয়েছেন ‘দুই ডোজ’!
করোনার টিকাসহ সার্বিক কোভিড ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটিও। অপর্যাপ্ত টিকার সংগ্রহ নিয়ে গণটিকার আয়োজন, শহর ও গ্রামাঞ্চলে ভিন্ন ধরনের টিকা কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানা বিষয়ে অব্যবস্থাপনার কথা জানিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘টিকাকেন্দ্রে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কোভিড-১৯ এ যত কিছু উল্টাপাল্টা হলো, এর কারণ হচ্ছে— অব্যবস্থাপনা, অপরিপক্কতা, অপরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার অভাব।’
স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যস্থাপনা যে দূর হয়নি, সমন্বয় তৈরি হয়নি সেটি দুই বছর শেষে এসে দেখা গেছে সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারিতে নেওয়া গণটিকাদান কর্মসূচিতেও। সেদিন একদিনে এক কোটি টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। সঙ্গে অধিদফতর ঘোষনা দেয়, টিকার প্রথম ডোজ দেওয়ার কাজ সেদিন শেষ করা হবে। এরপরে আর প্রথম ডোজ দেওয়া হবে না। আর এতে করে লাখো মানুষ ভোগান্তিতে পরে। টিকার প্রথম ডোজ শেষ বলে পুরো ব্যবস্থাকে লেজে গোবরে করে ফেলে অধিদফতর।
ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক একাধিকবার বলেছেন, ২৬ ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হচ্ছে টিকার প্রথম ডোজ কার্যক্রম। অথচ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গণটিকা কার্যক্রমের সময় আরও দুদিন বাড়ানো নিয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা কখনও বলিনি, করোনাভাইরাসের প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ফেসবুকে পেজেও একাধিকবার বিশেষ ঘোষণার শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি সম্পন্ন হবে টিকার প্রথম ডোজ প্রদান কর্মসূচি।’
মহামারিকালের দুই বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সমন্বয়হীনতা শুরু থেকেই দেখে আসছি জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাল্টিপল সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর কথা বলছে, যেটা অপ্রত্যাশিত।
মানুষকে তারা টিকা নিতে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের অনেকেই ২৬ ফেব্রুয়ারি টিকা নিতে এসেও পায়নি। ‘এটা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘মানুষকে তারা আসতে বলেছেন, মানুষ এসেছেন। কিন্তু সে উৎসবে তারা প্রতারিত হয়েছেন। তাদের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।’
তবে গত ৬ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন টিকাদান কর্মসূচিকে ‘অত্যন্ত সাকসেসফুল ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন বাংলাদেশ সুসম্পন্ন করেছে এবং করেই যাচ্ছে।
এ পর্যন্ত দেশে টিকার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রথম ডোজ পেয়েছেন ১২ কোটি ৫৩ লাখ ১৬ হাজার ৩২০ জন আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৩২ হাজার আট জন। সেইসঙ্গে বুস্টার ডোজ পেয়েছেন ৪১ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৯ জন।