গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আমানত ছিল ১৪ লাখ ৬২ হাজার ১৯ কোটি টাকা। তিন মাস পর ডিসেম্বর শেষে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৩৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এ সময়ে ব্যাংক খাত থেকে ৫২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা চলে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থাৎ, করোনার প্রভাব কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির চাকা যখন গতিশীল হয়ে উঠেছে, এমন সময় ৫২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে চলে গেছে অন্য খাতে। এতে টাকা পাচারের আশঙ্কা করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, করোনার সময় বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকায় টাকা বাইরে যেতে পারেনি। যে কারণে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল অস্বাভাবিক গতিতে। সেই তুলনায় এই সময়ে আমানত কমে যাওয়াকে অস্বাভাবিকই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ৫১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল ৫১ শতাংশের বেশি।
এত টাকা কোথায় গেলো?
ব্যাংক থেকে আমানত তুলে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ হলে সেটি ঘুরেফিরে ব্যাংকেই আসতো। কিন্তু তা আসেনি। আবার শেয়ারবাজার বা সঞ্চয়পত্রেও বাড়েনি বিনিয়োগ।
গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার। শেয়ারবাজারেও মন্দা অব্যাহত। অর্থাৎ প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা চলে গেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। অনেকের আশঙ্কা, এ টাকা পাচার হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে। করোনার পর হঠাৎ খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াও এর কারণ হতে পারে বলে জানান অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল। যে কারণে গ্রাহকদের টাকা ছিল ব্যাংকমুখী। করোনার প্রভাব কমায় মানুষের চলাচল বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংক থেকে আমানত কমছে। আবার অনেকে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে না রেখে বিভিন্ন স্থানে লগ্নিও করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আমানতের প্রবৃদ্ধি কমলেও ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
রেমিট্যান্সও কমেছে
ব্যাংকে আমানত কমে আসার আরেকটা বড় কারণ হিসেবে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কথাও বলা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা বেড়েছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২৭ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই টাকাও আমানত হিসেবে যোগ হতো। কিন্তু রেমিট্যান্স কমায় তা আসেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনায় ব্যবসায় মন্দা থাকায় গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে চলতি আমানত বেড়েছিল সাড়ে ৩ হাজার শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ওই হিসাবে আমানত কমেছে ৮২ শতাংশ। অবশ্য মোট আমানতের ৮০ শতাংশই মেয়াদি আমানত, যা মোট আমানতকে খুব একটা প্রভাবিত করে না।
জমানো টাকায় চলছে সংসার
অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যাংকে রাখা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যাদের আয় বাড়েনি, তাদের অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। আমানতের সুদ হার কমিয়ে দেওয়ার কারণে এমনটি হতে পারে বলেও মন্তব্য তার।
তিনি উল্লেখ করেন, আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে যে কী পরিস্থিতি হয়, কয়েক দফায় দেশের ব্যাংক খাত তা অনুভব করেছে। পরিস্থিতি যাতে সেদিকে না যায় সে বিষয়ে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বেড়েছে ইসলামি ব্যাংকের
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রচলিত ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ আমানত কমলেও ইসলামি ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে আমানত দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকায়। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ৩ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকটিতে ডিসেম্বর শেষে আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি।