ছবিসহ ভোটার তালিকা করা হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। এখন পর্যন্ত নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ খাতে কোটি কোটি টাকা খরচের পরও ২৫ শতাংশ ভোটার এখনো পাননি পরিচয়পত্র। যারা পেয়েছেন তাদের অনেকের পরিচয়পত্রে রয়েছে অসঙ্গতি। কিন্তু সংশোধন করতে গেলেই পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। অনলাইনে এনআইডি সংশোধনের ঘোষণা দিলেও তা সব সময় কাজ করছে না। এ বিষয়ে নেই কোনো প্রচারণাও।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মাসিক সমন্বয় সভায় স্মার্টকার্ড প্রকল্প পরিচালক এমন তথ্য উপস্থাপন করেন। সেখানে জানানো হয়, এরই মধ্যে ৭৫ শতাংশ ভোটারের উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) বিতরণ করেছে ইসি। অবশিষ্ট কার্ড বিতরণের কাজ চলছে। ওই সভায় স্মার্টকার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ‘ডাটা নট ফাউন্ড’ সমস্যাটি বড় বাধা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন কর্মকর্তারা।
২০০৮ সালে সাধারণ ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ শুরু করে ইসি। এরপর বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ২০১১ সালে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাক্সেস টু সার্ভিস (আইডিইএ)’ প্রকল্পের আওতায় ৯ কোটি নাগরিককে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কাজ হাতে নেয় ইসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে স্মার্টকার্ড উৎপাদন-বিতরণে অবার্থুর টেকনোলজিসের (ওটি) সঙ্গে চুক্তি করা হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেওয়ার পর ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর থেকে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও নির্ধারিত সময়ে কার্ড দিতে পারেনি ফরাসি এই কোম্পানি। এজন্য কোম্পানিটির সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করেনি কমিশন। বর্তমানে দেশে তৈরি স্মার্টকার্ড ব্যবহারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এসব বিষয়ে আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ-২) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের বলেন, বর্তমানে ইসির কাছে ৪৫ লাখের মতো ব্ল্যাংক স্মার্টকার্ড রয়েছে। এছাড়া বিতরণের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে সাত কোটির মতো কার্ড। এগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে পাঁচ কোটি ৭০ লাখ স্মার্টকার্ড। আইডিইএ-২ প্রকল্পের আওতায় আরও তিন কোটি স্মার্টকার্ড কেনা হবে। এজন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষর হলেই উৎপাদন শুরু হবে।
কবে থেকে দেশীয় স্মার্টকার্ড ব্যবহার করতে পারবো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অর্থবছর থেকেই দেশীয় কার্ড ব্যবহার শুরু করবো। জুনের মধ্যে আমরা ইনশাআল্লাহ দেশীয় কার্ড ব্যবহার শুরু করবো।
অবস্থা তুলে ধরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের বলেন, স্মার্টকার্ড প্রিন্ট করা হয়েছে সাত কোটি ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫৮টি। সেখান থেকে এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে সাত কোটি ৯ লাখ ৭৮টি। ভোটারদের মধ্যে স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হয়েছে পাঁচ কোটি ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৪৭২টি।
তিনি বলেন, আমাদের ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৫০ লাখের কাছাকাছি। আমাদের হাতে আছে সাড়ে সাত কোটি স্মার্টকার্ড। এছাড়া অবার্থুর টেকনোলজিসের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি পাচ্ছি এবং নতুন প্রকল্প থেকে কেনা হবে তিন কোটি। তাহলে সাড়ে ১২ কোটির মতো স্মার্টকার্ড আমাদের হাতে চলে আসবে। ফলে সবাইকেই দ্রুত সময়ের মধ্যে স্মার্টকার্ড দিতে পারবো বলে আশা করি।
বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময় মা-বাবার এনআইডি লাগে। এমনকি মৃত্যুর পরও মৃত ব্যক্তির পরিবারের নানা কাজে লাগে তার এনআইডি নম্বর। অপরাধী শনাক্ত করতেও এনআইডি জরুরি। কিন্তু এখনো সব ভোটারের কাছে তা না পৌঁছায় অনেকেই নানা হয়রানির মধ্যে পড়ছেন। অনেকে বিদেশে যেতে পারছেন না, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না। এমনকি নিজের নামে মোবাইল সিম পর্যন্ত কিনতে পারছেন না। এনআইডি না থাকায় অনেকেই পাচ্ছেন না সরকারি কোনো সেবা। ফলে এটি ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া এখন প্রায় কিছুই করা যায় না। এমনকি মোবাইলের সিমও কেনা যায় না। কেউ যদি অন্যের এনআইডি নিয়ে সিম কেনেন তাহলে অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। প্রযুক্তির অপরাধ প্রযুক্তি ছাড়া মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধে প্রযুক্তি ব্যবহারকারী, নিয়ন্ত্রক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে।
‘ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত রাখতে মোবাইল সিম নিবন্ধন ও কেওয়াইসি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ত্রুটিমুক্ত রাখতে হবে। এছাড়া গ্রাহকদের ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহারের ন্যূনতম দক্ষতা থাকলে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসসহ বিদ্যমান বিভিন্ন ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য সব ভোটারকে শিগগির এনআইডি দেওয়া উচিত।
এদিকে, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানেন না বেশিরভাগ ভুক্তভোগী। আবেদন প্রক্রিয়া জানা না থাকায় বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই এনআইডি সংশোধন করতে চলে আসছেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ে। অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করা যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো প্রচারণা নেই। অনলাইনে আবেদন করে তদবির না করলে কাজ হয় না। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার চেয়ে ছেলের বয়স বেশি এমনও ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া গেছে। নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম কিংবা গ্রামের নামের ভুল সংশোধনী নিয়ে মাস ও বছরের পর বছর মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন।
রাজধানীর আগারগাঁও এনইআইডি সংশোধনের কার্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, লালবাগের পোস্তা থেকে এসেছেন জহিরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় ছয় মাস আগে আামি অনলাইনে এনআইডি সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলাম। আমার নামের বানান ভুল ছিল। এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফল পাইনি। এজন্য আসতে হয়েছে। কিন্তু দু-তিনবার ঘুরেও সংশোধন করতে পারিনি।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের বাংলাবাজার ইউনিয়নের মৌলারপাড় গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুল মালেক। জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স অনুযায়ী ছেলে আবু তালেবের চেয়ে ১২ বছর ৬ মাস ১৯ দিনের ছোট তিনি! জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) বাবার তুলনায় ছেলে বয়সে বড়! বাবা ও ছেলে দীর্ঘদিন ধরে ঘোরাঘুরি করেও কোনো সমাধান পাচ্ছেন না। জেলা পর্যায় থেকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠালেও নির্বাচন কমিশনে এসে আটকে আছে। কিন্তু কেন আটকে আছে বাবা-ছেলে কেউই তা জানেন না। শুধু বলা হয় ওপর থেকে ফাইল নামেনি।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আব্দুল মালেক বলেন, একটি অযৌক্তিক ভুল সংশোধন করতে এক বছর ধরে ঘুরছি। আমরা বাবা-ছেলে কি না তারও প্রমাণ দিতে হয়েছে। জেলা কর্মকর্তা তদন্ত করে প্রতিবেদনও পাঠিয়েছেন। এরপরও আমরা এখনো সঠিক পরিচয়পত্র পাচ্ছি না।
ভোগান্তির কথা স্বীকার করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে অনেক হয়রানি আর ভোগান্তি হচ্ছে। কিছু কিছু মানুষের জন্য সুনাম বিঘ্নিত হচ্ছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রভুর মতো আচরণ করলে হবে না, জনগণের ভৃত্য হিসেবে কাজ করতে হবে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন অপরিসীম উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ভুল বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সংশোধনের ক্ষেত্রে কিন্তু ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ তা নয়। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়।
এনআইডির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে সিইসি বলেন, এটার (এনআইডি) আদিমতা আছে। আমরা সিনেমায় দেখেছি যে আদিকালে রাজা বা সম্রাট তার দূত পাঠাতেন অন্য সম্রাটের কাছে, উনি সেখানে গিয়ে তার পরিচয়পত্র পেশ করতেন। পরিচয়ের কিন্তু প্রয়োজন আছে, সেটার আবশ্যকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। আইডেনটিটি কার্ডের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু ব্যাপক।