করোনার নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা খরচ বাবদ ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ।
২০২০ সালের ১৫ জুলাই ভোরে বোরকা পরে সাতক্ষীরা সীমান্ত পার হওয়ার সময় র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন ধুরন্ধর এ প্রতারক। সে সময় গণমাধ্যমের শিরোনামে ছিল এখবর। দেশুজুড়ে আলোড়ন তুলে বিষয়টি।
কিন্তু প্রায় দুই বছর পর এসে সেই সাহেদ বলছেন, সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে তিনি গ্রেফতার হননি। র্যাব সদর দপ্তরে তিনি নিজেই এসে ধরা দেন।
এছাড়া তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদকে চিনতেন না বলে দাবি করেন।
আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাহেদ বলেন, ‘আমাকে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করা হয়নি।আমি আবুল কালাম আজাদ এবং অন্যদের চিনতাম না। আমাকে জামিন দেন। আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ১৬ বছরের মেয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আমার স্ত্রী বাড়ির বাইরে যেতে পারে না। আমার মেয়ের সহপাঠীরা তাকে চোরের মেয়ে বলায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করছিল। আমার বউকে সবাই চোরের বউ বলে ডাকে।’
বৃহস্পতিবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এ হাজির হয়ে জামিন চেয়ে এমন এসব বক্তব্য দেন সাহেদ।
পরে তার জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
সাহেদের আইনজীবী দবির উদ্দিন এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতের অনুমতি নিয়েই তার মক্কেল কথা বলেছেন। সাহেদ আদালতকে বলেছেন, সাতক্ষীরা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি নিজে র্যাব সদর দপ্তরে হাজির হয়েছিলেন। পরে তাকে সাতক্ষীরা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
যদিও দু’বছর আগে সাহেদ গ্রেফতারের পর র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এক সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য বলছে ভিন্ন কথা।
তখন জানানো হয়, রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযান হতে পারে এমনটি আঁচ করতে পেরে ঢাকা ছেড়ে নরসিংদী হয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী যান সাহেদ।
এরপর অভিযান বন্ধে ও নিজেকে বাঁচাতে এক সময়ের পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। এসব জায়গা থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে দেশ ত্যাগের সব চেষ্টাই ছিল তার। কখনও ব্যক্তিগত পরিবহণে, কখনও হেঁটে, কখনও আবার ট্রাকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ান তিনি।
র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও ৮ দিন পর গ্রেফতার হন বহুল আলোচিত এ প্রতারক।
২০২০ সালের ১৫ জুলাই ভোর ৫টার দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদী পার হওয়ার জন্য বোরকা পরে মাছ ধরা নৌকায় উঠেছিলেন সাহেদ।
সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। উদ্ধার করা হয় তিন রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি অবৈধ অস্ত্র। এ সময় নদীতে সাঁতরে পালিয়ে যান ট্রলার চালক।
সে সময় সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, তিনি (সাহেদ) উত্তরা শাখায় অভিযান শুরু হওয়ার খবর শুনেই ঢাকা ছাড়েন। চলে যান নরসিংদীর মাধবীতে। এরপর যান কক্সবাজারের মহেশখালীতে। এর মধ্যে চেষ্টা করতে থাকেন পরিচিতজনদের দিয়ে অভিযান থামাতে এবং তাকে যেন গ্রেফতার করা না হয় সেই তদবির করতে।
কল করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও। কোথাও ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তিনি আবার ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন। তখন দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি চলছিল। তার গাড়িটি কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসার পথে টের পান কুমিল্লায় সড়কে র্যা বের তল্লাশি চলছে। তখন সুকৌশলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে যান। তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।
এ অবস্থায় ভেজা কাপড়েই ওঠেন একটি টমটম জাতীয় পরিবহণে। সেখান থেকে রাস্তা পরিবর্তন করে একটি জায়গায় নেমে ওঠেন পাবলিক বাসে। ফের অবস্থান পরিবর্তন করেন। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ছিলেন। এর মাঝে ঢাকায়ও আসেন। তার মূল টার্গেট ছিল দেশত্যাগ করা। এক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে থাকা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন তিনি।
কিন্তু বৃহস্পতিবার জামিন চাইতে এসে সাহেদ র্যা বের এসব তথ্যকে মিথ্যা দাবি করে জানালেন, তিনি নিজেই র্যা ব সদর দপ্তরে হাজির হয়েছিলেন। পরে তাকে সাতক্ষীরা নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়।
এদিকে এ মামলায় সাহেদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়ে আগামী ১২ মে দিন ধার্য করেছেন আদালত।
অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন – স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, সাবেক পরিচালক আমিনুল হাসান, উপপরিচালক (হাসপাতাল-১) মো. ইউনুস আলী, সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল-১) মো. শফিউর রহমান ও গবেষণা কর্মকর্তা মো. দিদারুল ইসলাম।